
Human Face
করোনা চিনিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সৃষ্টির সেরা বলে দাবীদার মানুষের আসল চেহারা
রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল। আমাদের কাছে হাসপাতাল থেকে ফোন এলো– তাদের আইসিইউতে একজন রোগী মারা গেছেন। তাকে দাফন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা হাসপাতালে গিয়ে মুখোমুখি হলাম এক মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতার। কারণ, অনেক খোঁজার পরেও মৃতের কোনো আত্মীয়, অভিভাবক কাউকে পাওয়া গেল না, যার সাথে কথা বলে তার দাফনের ব্যবস্থা করা হবে। হাসপাতালের আইসিইউতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মৃত ব্যক্তি হলেন একজন ডাক্তার, নামী অধ্যাপক (সংগত কারণে আমরা নাম প্রকাশ করছি না)।
এদিকে, দীর্ঘ সময় ধরে অনেক খোঁজ করার পরেও যখন তার কোনো আত্মীয় বা অভিভাবক পাওয়া যাচ্ছে না। তখন আমাদের দ্বিধান্বিত অবস্থা– কী করবো। অবশেষে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, আত্মীয় পাওয়া যাচ্ছে না বলে তাকে ফেলে রেখে চলে যাব না। বরং বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে হলেও তাকে দাফন করা মানবিক কর্তব্য।
যেই ভাবা সেই কাজ। হাসপাতাল থেকে ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে থানায় জিডি করে থানার কাছ থেকে একটা নো অবজেকশন সার্টিফিকেট নিতে হবে। এরপর বেওয়ারিশ লাশ হিসেবেই তাকে দাফনের সিদ্ধান্ত হলো।
শেষ পর্যায়ে আমরা ভাবলাম, একজন নামী ডাক্তার, অধ্যাপক। তার কেউই নেই, এটা কীভাবে সম্ভব? তিনি বেওয়ারিশ হন কীভাবে? পরে আমরা আবারো হাসপাতালে যোগাযোগ করি এবং খোঁজ নেই যে, এতদিন তিনি হাসপাতাল ছিলেন, কীভাবে ভর্তি হলেন। তার কোনো আত্মীয় কি ছিল না? কর্তৃপক্ষ বলল, তিনি জীবিত থাকাবস্থায় অনেকে যোগাযোগ করেছিল। সেই নাম্বার ধরে ফোন দিলে তারা বলল, মৃত ব্যক্তি তাদের কেউ না। অর্থাৎ মারা যাওয়ার পর আর কেউ তাকে স্বীকার করছেন না। তারা সবাই ফোনে বলে দিলেন, এই নামে তাদের কোনো স্বজন বা পরিবারের কেউ মারা যায় নি।
পরে একটা সূত্র পাওয়া যায় যে, তিনি ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত খ্যাতনামা এক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এসে ভর্তি হয়েছেন। সেই হাসপাতালে ফোন করার সাথে সাথে তারা মুহূর্তেই চিনে ফেললেন যে, তিনি তাদের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক। তখন সেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃতের স্বজনদের নাম্বার দিলেন। জানা গেল, তার (মৃতের) ছেলে কানাডায় থাকেন।
তার ছেলের সাথে কয়েকবার চেষ্টা করে ফোনে কথা হলে তিনি জানালেন, দেশে তাদের তেমন কেউ নেই। তাই তিনি অনুরোধ করলেন, আমরা যেন তার বাবার লাশ দাফনের ব্যবস্থা করি। আর তাকে যেন বাবার শেষকৃত্য ভিডিও করে বা ছবি তুলে কানাডায় পাঠানো হয়!
এর একটু পরেই একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলো। চট্টগ্রাম থেকে একজন ডাক্তার ফোনে বললেন, মৃতের ওযু গোসল সব শেষে ব্যাগিং করে আমরা যদি পাঠিয়ে দেই, তাহলে তাকে মিরসরাই দাফন করবে তারা। তারপর আবার হঠাৎ তিনি জানালেন যে, মিরসরাই তাকে দাফনে আগ্রহ বোধ করছেন না তারা।
পরে আরো জানা গেল যে, মৃত অধ্যাপক হলেন দেশের একজন উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তার বন্ধু এবং ঘনিষ্টজন। সেদিন সেই কর্মকর্তার আরেকজন আত্মীয় মারা যাওয়ায় তিনি স্বাভাবিকভাবেই তার দিকে মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। তাই তার জুনিয়র সহকর্মীকে দায়িত্ব দিয়েছেন বিষয়টি দেখভাল করার জন্যে। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করে এসএমএসের মাধ্যমে আমাদের জানান।
মৃতের লাশ কোথায় দাফন করা হবে, মৃতের কোনো আত্মীয় তার কাছে আসতেও আগ্রহী না, মৃতের কোনো আত্মীয়ের পক্ষ থেকে যখন কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় অবশেষে সেই প্রশাসনিক কর্মকর্তার অফিস থেকে সিদ্ধান্ত এলো যে, মৃত অধ্যাপককে ঢাকাতেই রায়ের বাজার বধ্যভূমি গোরস্থানে দাফন করা হবে। এরপরে মৃতের ভাই, যিনি নিজেও একজন পদস্থ কর্মকর্তা, তিনি ফোনে জানালেন যে, তিনি তার এক কর্মচারীকে পাঠাচ্ছেন দাফনের সাক্ষী হিসেবে।
কী মর্মান্তিক! এত বিখ্যাত একজন ডাক্তার, নাম বলা মাত্রই যাকে সবাই চিনে ফেলেছেন হাসপাতালে, এত বড় একজন অধ্যাপক! তাকে যখন অন্তিম বিদায় জানানো হবে, তখন তার পাশে থাকার জন্য, সাক্ষী হিসেবে স্রেফ একজন কর্মচারী পাঠানো! আতঙ্ক আমাদের কোথায় নিয়ে গেছে! মৃতের আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগের কোনো সূত্রও পাওয়া যাচ্ছিল না শুরুতে। যা-ও কয়েকজনের সাথে যোগাযোগ হলো, তারা কেউই আসেন নি; বরং একজন কর্মচারী পাঠিয়েছেন।
ঢাকার খ্যাতনামা এক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক। কত অর্থবিত্ত খ্যাতি সুনাম প্রতিপত্তি! এতকিছু থাকার পরেও তিনি এখন বেওয়ারিশ! সব থাকার পরেও তার শেষ যাত্রা হলো যাদের কেউ নেই তাদের শেষ যাত্রার মতো সেই বধ্যভূমি গোরস্থানে। অনেকটা বেওয়ারিশ মানুষের মতোই।
অবশেষে রাত ১১টায় সেই গভীর অন্ধকারে আমরা কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীই যেন তার স্বজন, যারা পরম মমতায় তাকে সমাধিস্থ করি অন্য যে-কোনো পরিচয়হীন মানুষের মতো।
হতভাগ্য ওই চিকিৎসক ছিলেন অধ্যাপক ডাঃ মহিউদ্দিন, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ।
(একটি স্বেচ্ছাসেবী দাফন কার্যক্রম টিমের এক সদস্যের বাস্তব অনুভূতি।
[ সূত্রঃ একুশে টিভি ]
Related Posts

Do not belittle anyone’s profession – ensure their rights instead
Look at the narrative pushed by the so-called elite Bangu media and society! This isRead More

কারো পেশাকে ছোট করবেন না, বরং তার অধিকার নিশ্চিত করুন
বাঙ্গু সুশীল মিডিয়া ও সমাজের ন্যারেটিভ দেখেন! এটা বাংলাদেশের মানুষের খুব বড় একটি দৈন্য। এরাRead More

How much longer will the Muslim extremists in Bangladesh continue to oppress Hindus?
Ever since I became aware of the world around me in Bangladesh, I’ve witnessed violenceRead More
Comments are Closed