
Anthropology of Theft
চোর ও চৌর্যবৃত্তির জন্য মানুষের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট কতটা ভূমিকা রাখে তার উদাহরন !
ঢাকা শহরের রাস্তায় হাঁটাটা খুব বিরক্তিকর ব্যাপার। একেতো ভাঙ্গাচোরা ফুটপাথ, তার উপরে দোকানদাররা ২/৩ ভাগ রেখেছে দখল করে, কোথাও মানুষ জটলা পাকিয়ে আড্ডা দেয়, চা/বিড়ির দোকানের সামনে বেঞ্চ পেতেও রেখেছে ফুটপাথে। ২ দিন আগে এই বিরক্তি নিয়ে রওনা দিলাম নতুন কেনা বাই-সাইকেলটার জন্য লক কিনতে। ৭-১২০০০ টাকার সাইকেলের জন্য এদেশে ৫০০-১৫০০ টাকার লক কিনতে হয়, ২ কেজি ওজনের শিকল নিয়ে ঘুরতে হয়। না হলে কখন কোথা থেকে চোখের পলকে সাইকেল নাই হয়ে যাবে টের পাবেন না। পুলিশ, নেতা কেউ উদ্ধার করে দিবে না।
এই যে কোন জিনিস কিনলে আগেই আপনাকে ভাবতে হবে কিভাবে সেটা নিরাপদ করে রাখবেন ! এমনই এক চোরের প্রজননস্থল আমাদের এই জন্মভূমি। শুধু নিজের ও জিনিসের নিরাপত্তার জন্যই এদেশে অনেক টাকা ও সম্পদ নষ্ট হয়, সঙ্গে টেশশান ও সময় তো হিসাবের বাইরে।
বাইরের দেশে এমন সাইকেল, মোটর সাইকেল, গাড়ি রাস্তায় ফেলে রাখলেও কেউ নেয় না। শুধু কি দরিদ্রতার কারনে এমন করে মানুষ ? না ? এটা স্বভাব, শত শত বছর ধরে নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্টে স্থান করে নেয়া খাসলত এগুলো। কাজ না করেই জীবন চালানোর মতলব। এই একই বৈশিষ্ট ধারন করে পশ্চিম বাংলার মানুষ, ইন্ডিয়ার বড় অংশের মানুষ। অন্যদিকে আমাদের দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ আদিবাসীদের দেখেন, সেখানে এমন উদাহরন খুব বিরল।
আপনাকে উদাহরনের জন্য ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া টানতে হবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বে দেশের গাঁয়ে গাঁ লাগানো ইন্ডিয়ার মিজোরামকে দেখুন। খ্রীস্টান অধ্যুষিত এই অঞ্চলে রাস্তার পাশে শত শত দোকান আছে কোন দোকানদার ছাড়া। জিনিসের গায়ে দাম লেখা আছে, মানুষ কেনে, খোলা বক্সে টাকা রাখে, ভাংতি না থাকলে ভাংতি করে নেয়। ইউটিউবে সার্চ দিয়ে দেখুন, অনেক ভিডিও পাবেন। পাশাপাশি দুইটা দেশ, পার্থক্য শুধু নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্টে। এতেই এক অঞ্চলে চোরের আধিক্য, অন্যটায় চুরি জানে না মানুষ। সঙ্গের ছবিটা মিজোরামের রাজধানীর একটি দোকান যেখানে কোন দোকানদার নেই।
বার্মার রাস্তায় রাতে মানুষ তাদের গাড়ি পার্ক করে রাখে, কেউ থাকে না সেখানে। আমরা আবার বার্মার মানুষকে অপছন্দ করি। রাখাইন মানে বার্মা নয়, রাখাইনের মানুষ দিয়ে বার্মার সমস্ত মানুষকে বিচার করা যায় না। রাখাইনের মানুষের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট বাংলাদেশের মানুষের কাছাকাছি।
বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৫২ কিলোমিটার দূরের ভূটান। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ট এই দেশের রাজধানী শহরের অনেক মার্কেটের দোকানপাট রাতে খোলা রেখেই দোকানীরা চলে যান। সকালে এসে সবাই আবার দোকানে বসে যান। তাদের মানুষ চিন্তাও করে না একটা খোলা দোকান থেকে জিনিস চুরি করতে হবে ! ঐ এখানেও নৃবিজ্ঞান।
যদি বলেন আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম, তবে বলি আপনি ৬০/৭০ বছর আগে ফিরতে পারবেন না তবে সেদিনের গল্প, উপন্যাস, সিনেমা দেখেন। বুঝবেন তখনো মানুষ চুরি-চামারি, ডাকাতি, দূর্নীতি এসব করতো এখনকার মতো। সেদিনের চেয়ারম্যানরাও গম চুরি করতো। তখনই মানুষ এখনকার মতো একই কথা বলতো, কি জামানা আসলো ! ১০০/২০০ বছর পিছনে গেলেও চুরি-চামারির উৎসব দেখবেন। অন্যরা উন্নতি করে, আমরা সমানতালে থাকি বা আরো বেশী অবনতি করি, এই পার্থক্য।
আমার ছোট্ট ২/১ টা ওয়েবসাইট আছে। যেখানে প্রতিদিন একাধিক ই-মেইল আসে ‘এ্যাসাইনমেন্ট হেল্প’ সাইট থেকে। তারা স্প্যামিং করে ফোরামে তাদের সাইটের লিংক পোস্ট করতে চায় অথবা একটা টেকনিক্যাল আর্টকেল লিখে দিয়ে বিনিময়ে একটা নো-ফলো লিংক চায় আমার সাইট থেকে। এইযে এ্যাসাইনমেন্ট হেল্প, এটা এখন বিরাট ব্যবসা। স্কুল, কলেজে এখন এ্যাসাইনমেন্ট চালু হয়েছে। কিন্তু একশ্রেনীর ছাত্র-ছাত্রী এই এ্যাসাইনমেন্ট নিজে না করে টাকা দিয়ে এসব সাইট থেকে করিয়ে নেয়। চৌর্যবৃত্তির শুরুটা এদেশে ছোট থেকেই হয়। বাবা, মা, শিক্ষক সবাই এই প্রক্রিয়ায় অবদান রাখে।
————
আমি যখন প্রাইমারীতে পড়তাম তখন আমি ক্লাস ফোর এ পড়ার সময় ফাইভের ক্লাস নিয়েছি। স্যার ঘুমাতেন, আমাকে ডেকে ক্লাস নেয়াতেন। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা আমার নিজের জীবনের ঘটনা। আমি মেধাবী কেউ না, কিন্তু এসবগুলো ঘটেছিল। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আমি ইন্টারমিডিয়েটের পদার্থ বিজ্ঞান বই পড়তাম। আমাদের বাসায় যখন ইলেকট্রিসিটি আসেনি তখন আমি ভোল্ট, এ্যাম্পায়ার, ওয়াটের প্রাথমিক সূএগুলো জানতাম। আমার মেধা জাহির করতে চাচ্ছি না, কিন্তু বোঝাচ্ছি বই পড়ার ও জানার আগ্রহটা আমার ছিল। আমার আব্বা এটা তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই কাঁদাময় গ্রামেও আমাদের বাড়িতে ১ দিনের বাসী পত্রিকা ও ম্যাগাজিন থাকতো। যারা বই পড়ে আগ্রহ নিয়ে, যাদের জানার চেষ্টা থাকে প্রতিনিয়ত তারা অসৎ হতে দ্বিতীয়বার ভাবে।
প্রাইমারীতে পরীক্ষার সময় শিক্ষকেরা মুখে বলে দিতেন, আর ছাত্ররা সেটা ১ পৃষ্ঠার কাগজে লিখতো। আমার জন্য ছিল বিপরীত। আব্বা বলে দিয়েছিলেন, এই নিয়ম আমার চলবে না, সবাই লিখতো শিক্ষকের বলা প্রশ্নের উত্তর, আর আমি লিখতাম একেবারে টেবিলে দাঁড়িয়ে নিজের বের করা উত্তর। মুখস্ত আমি কখনোই করতাম না। সবকিছু মুখস্ত করাটাও একপ্রকার চৌর্যবৃত্তি।
এদেশের শিশুদের সামনের উদাহরনগুলো কেমন যেন চোর হওয়ার সহায়ক। এইযে, স্কুলে মুখস্ত করানো হয় গাদা গাদা জিনিস। নিজের মতো লিখলে নাম্বার বেশী পাওয়া যায় না। এতে করে বাচ্চাদের নিজের শক্তির উপরে ভরসা জন্মে না, সারাজীবন হীনম্যতায় ভোগে ও অন্যের জিনিস কপি করে চালাতে অভ্যস্ত হয়। কাগজে কপি করা আর মাথায় মুখস্ত কপি করা একই। এদেশের বেশীরভাগ সিভি’ই অন্যের থেকে কপি করা, ক্যরিয়ার অবজেক্টিভে ইংরেজীতে কি লেখা আছে, তার অর্থ এদের অধিকাংশই জানে না। লেখাপড়া থেকে শুরু করে অফিস আদালতে সর্বত্র চৌর্যবৃত্তি এখানে স্বীকৃত। শুধু আর্থিক চুরিকে এদেশের মানুষ চুরি মনে করে, অন্যগুলোকে চুরি মনে হয়না।
এদেশের বেশীরভাগ মানুষ জানেই না, তাদের ল্যাপটপ, কম্পিউটারে ব্যবহৃত সফটওয়্যারের প্রায় পুরোটাই চুরি করা। আমি আপনিও হয়তো বাধ্য হয়ে এটা করেছি, কিন্তু সামর্থ্য বা সুযোগ আসার পরেও সেই অভ্যাস ছাড়িনি।
মোটকথা চুরির এই অভ্যাস শুধু সাইকেল চুরির চোর বা ম্যানহোলের ঢাকনা চুরির ছিঁচকে চোরদের মধ্যেই নেই; এটা আছে জাতিগতভাবে আমাদের প্রায় সবার। এটা পরিবেশ, প্রতিবেশ, সামাজিক মূল্যবোধ দিয়েই সৃষ্ট। এই মানুষগুলোই ভিনদেশে গিয়ে আবার বাধ্য হয়ে বা নিজ থেকেই চুরি-চামারি ছেড়ে দেয়। সেখানকার পরিবেশ, প্রতিবেশই বাধ্য করে।
Related Posts

Do not belittle anyone’s profession – ensure their rights instead
Look at the narrative pushed by the so-called elite Bangu media and society! This isRead More

কারো পেশাকে ছোট করবেন না, বরং তার অধিকার নিশ্চিত করুন
বাঙ্গু সুশীল মিডিয়া ও সমাজের ন্যারেটিভ দেখেন! এটা বাংলাদেশের মানুষের খুব বড় একটি দৈন্য। এরাRead More

How much longer will the Muslim extremists in Bangladesh continue to oppress Hindus?
Ever since I became aware of the world around me in Bangladesh, I’ve witnessed violenceRead More
Comments are Closed