Vaccination for the First Time

Vaccination for the First Time

যে ২২ জন এতিম শিশুর কাছে ঋনী এ বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষ

ঘটনা ১৭৯৮ সালের, রাজা চতুর্থ কার্লোস স্পেন শাসন করছেন। এ সময় রাজকুমারী মারিয়া লুইজা আক্রান্ত হলেন স্মলপক্সে। এই রোগ তখন লোহিত মৃত্যুবান নামে পরিচিত, রাজকুমারীর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবরে পুরো রাজপ্রাসাদে নেমে এলো আতঙ্ক, মারাত্মক সংক্রামক এ রোগ। ছড়াতে সময় লাগে কম এবং পরিণাম নিশ্চিত মৃত্যু। রাজকুমারীর আক্রান্ত হওয়ার খবরে আতঙ্কিত হলেন রাজাও। কারণ এখন এই রোগ ছড়াবে রাজপ্রাসাদের মাঝে।

স্মলপক্স বা ভেরিওলা তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে ভয়াবহ এক মহামারী বলে বিবেচিত হতো। এর কারণও আছে। দশ বা কুড়ি বছর পরপর একবার এ রোগ দেখা দিলে গ্রামকে গ্রাম মানুষ মরে সাফ হয়ে যেত। মৃতদেহ সৎকারের লোকও পাওয়া যেত না। এ রোগের কারণ ভেরিওলা নামের একটা ভাইরাস।

প্রতিবার করে মহামারীতে যে দু’একজন লোক বেঁচে যেত তাদের আর ভয় থাকতো না। কারণ এ রোগের বিরুদ্ধে তাদের শরীরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে কিন্তু মহামারী পরবর্তী মানুষদের হতো সমস্যা।
রোগ হলে নিশ্চিত মৃত্যু না হলেও শারীরিক স্থায়ী ক্ষতি অনিবার্য। এ রোগের উপসর্গ হলো, উচ্চ মাত্রার জ্বর, বিবমিষা, শরীরে ব্যাথা এবং চুলকানী যুক্ত লাল ক্ষত, রোগাক্রান্ত যারা বেঁচে যেতো তাদের শরীরে স্থায়ী ক্ষত দাগ তো থাকতোই এবং কেউ কেউ হয়ে যেত অন্ধ।

রাজকুমারী মারিয়া লুইজা সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিলেন। রাজা চতুর্থ কার্লোস তাঁর পরিবারের বাকী সবাইকেও রোগের হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন। তিনি যে পন্থায় নিজের পরিবার বাঁচিয়েছিলেন তা পরবর্তীতে পুরো পৃথিবীতে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে।

গরুর রোগঃ

১৭৯৬ সালে ইংল্যান্ডের এক চিকিৎসক ড. এডওয়ার্ড জেনার দেখালেন যে, যে ব্যক্তি কাউপক্সে আক্রান্ত হয় সে স্মলপক্স থেকে পুরোপুরি সুরক্ষিত।

কাউপক্স হচ্ছে গরুর এক ধরনের রোগ, এ রোগ মানুষেরও হতে পারে। কাউপক্স এবং স্মলপক্স এর ভাইরাসের প্রায় কাছাকাছি প্রজাতির ভাইরাস। দুই ক্ষেত্রেই শরীরে যে দাগ বা ক্ষত তৈরি হয় তা দেখতে প্রায় একই রকম। কিন্তু বিষয় হচ্ছে কাউপক্স মানুষের হলে সে মারা যায় না। কিছু দিন অসুস্থ থেকে সেরে ওঠে।

সুস্থ মানুষের কাউপক্স হওয়ানোর জন্যে ড. জেনার নতুন একটি প্রক্রিয়া ব্যবহার করলেন, এর নাম তিনি দিলেন আর্ম টু আর্ম ট্রান্সফার। এতে প্রথমে তিনি কাউপক্সে আক্রান্ত একটি গরুর বা মানুষের ক্ষত থেকে তরল নিয়ে সুস্থ ব্যক্তির শরীরে ক্ষত তৈরি করে তাতে ঢুকিয়ে দিতেন। এতে সুস্থ ব্যক্তির ভেতর ঢুকে যেতো কাউপক্সের ভাইরাস। সুস্থ ব্যক্তিটি কাউপক্সে আক্রান্ত হতেন, সপ্তাহ কয়েক পর সেরেও উঠতেন। এতে ওই ব্যক্তির শরীরে কাউপক্স এবং সেই সাথে স্মলপক্সের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠতো।

পুরো প্রক্রিয়াটির নাম ড. জেনার রাখলেন ‘ভ্যাক্সিনেশন’। ল্যাটিন শব্দ ‘ভ্যাক্সিনেশন’ থেকে এসেছে ‘ভ্যাক্সিনেশন’ শব্দটি। ভ্যাক্সিনাস এর অর্থ হলো গরু সম্পর্কিত। ড. জেনার যে এই ভ্যাক্সিনটি আবিস্কার করেন তা হলো সংক্রামক কোন রোগের বিরুদ্ধে মানব সভ্যতায় প্রথম আবিস্কৃত প্রতিরোধক।

আটলান্টিকের ওপারেও ভ্যাক্সিনঃ

রাজা চুতর্থ কার্লোস শুধু নিজের পরিবারের ভ্যাক্সিনেশন শেষ করেই থেমে থাকেননি। রাজ কোষের অর্থ ব্যয়ে তিনি পুরো স্পেন সাম্রাজ্য ভ্যাক্সিনেশন বা টীকাদান কর্মসূচী গ্রহণ করেন। তিনি রাজ চিকিৎসক ফ্রান্সিকো জেভিয়ার ব্যালমিসকে স্পেন অধিকৃত প্রতিটি রাজ্যে ড. জেনারের এই টীকা দেওয়ার নির্দেশ দেন। স্পেনের রাজ্য তখন আমেরিকার উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। (পরবর্তীতে ফিলিপাইনেও স্পেনের বিজয়ের মাধ্যমে ফিলিপাইন স্পেনের রাজ্য হয়ে যায়)।
রাজার নির্দেশ পালন করার জন্যে ড. ব্যালমিস কে কাউপক্স এর ভাইরাস বয়ে নিয়ে যেতে হয় মহাসাগর পেরিয়ে শহর থেকে শহরে। এই দীর্ঘ যাত্রায় ভাইরাসকে জ্যান্ত রাখার জটিল কাজটি তাকে করতে হয়ে একটু বিচিত্র উপায়ে।

দুটি উপায় ব্যবহার করেছিলেন ড. ব্যালমিস। কাউপক্স এর ক্ষত থেকে তরল নিয়ে কাঁচের জারে সীল করে প্রথমে চেষ্টা করেছিলেন ব্যালমিস, কাজ হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মরে গিয়েছিলো ভাইরাস। শেষে দ্বিতীয় আরেকটি উপায় বেছে নেন তিনি।

মানব শৃঙ্খলঃ

ড. ব্যালমিস এর দ্বিতীয় রাস্তাটি হলো মানুষ ব্যবহার। সমস্যা হলো কোন ব্যক্তি কাউপক্সে আক্রান্ত হলে দুই বা তিন সপ্তাহের মধ্যেই সেরে উঠতো। দীর্ঘ যাত্রায় তাই ড. ব্যালমিস ব্যবহার করেছিলেন হিউম্যান চেইন বা মানব শৃঙ্খল।

যাদের কখনও কাউপক্স বা স্মলপক্স হয়নি তেমন লোকদের বেছে নিয়েছিলেন ড. ব্যালমিস, দেখা গেল বেশিরভাগ প্রাপ্ত বয়স্কদের দুরোগের যে কোন একটি হয়ে গেছে। কিন্তু এমন অনেকবারই আছে যাদের কখনও দুই রোগের একটিও হয়নি।

সরকার থেকে অবশেষে বাইশ জন এতিম শিশুর একটি দল ঠিক করে দেওয়া হয়। এদের সবার বয়স ছিলো তিন থেকে নয়ের মধ্যে। এরাই মানব শৃঙ্খল বা হিউম্যান চেইন এর মূল সদস্য ছিলো, সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় দলটির একের পর এক সদস্যকে ক্রম পর্যায়ে আর্ম-টু-আম ট্রান্সফারের মাধ্যমে রোগাক্রান্ত করে জ্যান্ত ভাইরাসকে স্পেনীয় উপনেবেশে নিয়ে গিয়েছিলেন ড. ব্যালমিস।

১৮০৩ থেকে ১৮০৭ সালের মধ্যে প্রায় লাখ খানেক লোককে টীকা দেন ড. ব্যালমিস। এই ছিলো দীর্ঘ মাত্রায় টীকা দানের প্রথম উদাহরণ।

কর্মসূচী শেষে এতিম শিশুদের রাজা রাজ্যের পক্ষ থেকে ভরন পোষন ও শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। তারা সবাই পরে বড় হয়ে উঠে মেক্সিকোতে। ওই বাচ্চাদের কারণে লক্ষ লক্ষ লোক স্মলপক্সের মতো মহামারীর হাত থেকে বেঁচে যায়।

১৯৬৭ সালে একদল চিকিৎসক পৃথিবী ব্যাপী এ রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে। শুরু হয় বিভিন্ন দেশে সরকারের পক্ষ থেকে টীকাদান কর্মসূচী। পৃথিবী থেকে এ রোগ পুরোপুরি নির্মুল হয়ে যায়। ১৯৭৯ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত এ রোগে কোন ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন বলে শোনা যায়নি।
এতিম সেই বাইশজন শিশুর প্রতি আমরা সবাই কৃতজ্ঞ।

Related Posts

Splitting of the Moon and Islamic Myth

ফেবু মুমিনদের সহজ সরলতা, কুযুক্তি ও শেষে চাপাতির কোপ !

ফেসবুকীয় মুমিন মানেই ‘ছাগল” অন্যকথায় ছাগু (ফেসবুক আবার তাদের সম্মানার্থে ছাগু সরাসরি লিখলে গোস্বা করেRead More

Religious Sentiments and Science Education in Bangladesh

ধর্মীয় অনুভূতির দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষার পশ্চাৎযাত্রা

বাংলাদেশে সাইন্সের স্টুডেন্টদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। সারাবছর বিজ্ঞানের জাহাজ মাথায় নিয়ে ঘুরবে, কিন্তু বিশ্বাস করবেRead More

C-Section and Evolution

সি সেকশান বা সিজারিয়ান প্রক্রিয়ায় বাচ্চা জন্মদানে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়ছে

বিবর্তনবাদ তত্ত্ব বলছে যে, মানুষ আর পথিবীর বুকে চরে বেড়ানো অন্যান্য বাদঁর কিংবা বন-মানুষেরা অনেকRead More

Comments are Closed