malala yousafzai

Malala Yousafzai

মালালার নোবেল প্রাপ্তি ও বাঙ্গালী ফেসবুকীয় পন্ডিত সমাজ

প্রথমেই বলি, নোবেল শান্তি পুরস্কারের যথার্থ দাবীদারের হাতেই পুরস্কারটি গেছে। মালালা ইউসুফজাইকে অভিনন্দন!  অভিনন্দন কৈলাশ সত্যার্থী। 

একজন পাকিস্থানি ১৭ বছরের তরুনী অন্যজন ভারতের ব্যক্তি। বাংলাদেশের ফেসবুক পন্ডিতদের মাঝে কৈলাশ সত্যার্থী কে নিয়ে যতটা না আলোচনা তার চেয়ে বেশী সমালোচনা মালালা কে নিয়ে। সবার অভিযোগ মালালা নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য না। কিন্তু কেন?লোবেলের দাবীদার ছিলেন অনেকে। বাঙ্গালী ফেসবুকীয় পন্ডিতকূল তাদের কারো নামও জানত না এক মালালা ছাড়া। কৈলাশ সত্যার্থীর নাম কয়জন জানতেন তার নোবেল প্রাপ্তির পূর্বে?

নোবেল শান্তি পুরস্কারটা সবসময় রাজনৈতিক। আর এটি বিশ্বপরিসরে দেয়া হয় বলে বিশ্ব সমস্যা ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখানে একটা ভূমিকা রাখে বৈকি? আমাদের দৈন্যতা হল আমরা নিজেরা যা পারি না আমার আশে পাশের কেউ সেটা পারলে আমাদের হিংসা হয়। নোবেলের দাবীদার যারা ছিলেন বা এখনো আছেন সামনের বছরগুলোতে তাদের কি নোবেল পাওয়ার মত যোগ্যতা নেই? অবশ্যই আছে। তাই বলে একজন নোবেল পেয়েছে বলে তাকে খাটো করে দেখতে হবে? 

‘সারাদিন নর্দমা ঘাটা যার স্বভাব, ফুলের গন্ধ তার নাকে যায় না’। গান্ধী কি বলেছিলেন কথাগুলো? যেই বলুন, মালালা প্রসঙ্গে বাঙালির ফেসবুকীয় বুদ্ধিজীবীতার নমুনা দেখে আমার নিরেট মাথায় কেন যেন এ কথাগুলোই বারে বারে ঘুরে ফিরে উঠে আসছে।

মালালা সম্বন্ধে একবিন্দু না জেনে তার কাজ, কিংবা অবদান সম্বন্ধে এতটুকু জ্ঞান না রেখে ফেসবুকের গালিবাজরা গালির তুবড়ি ছোটাচ্ছেন অহর্নিশি – “একটা গুলি খায়াই নোবেল পায়া গেল?” কেউ বা বলছেন, “মালালা একটা গুলি খেয়ে নোবেল পাইল, আমারে কামান মার”, কেউ আবার বলছে, “একটা গুলি খাওয়া ছাড়া মালালার শান্তিতে কি অবদান আছে?”

বেচারি মালালা। মাত্র ১৭ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী হয়েও গালি খাচ্ছেন তালিবানদের, মৌলবাদীদের, কমিউনিস্টদের। সবার। তালিবানি মৌলবাদী ঘরনার লোকজন মালালার উপর কেন ক্ষ্যাপা তা বোধ হয় বিশ্লেষণ না করলেও চলবে। কিন্তু অন্যরা? অন্যদের ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং! তার মানে তাদের মনেও প্রচ্ছন্ন তালিবানি ভূত চেপে আছে। 

যারা মালালার নোবেল প্রাপ্তিতে খুশি নন তারা বলুন, কে নোবেল পেলে ভাল হত? কোন অবদান আছে তার শান্তির জন্য? মালালে কেন নোবেল পেয়েছে? জানেন এসব? যদি না জানেন তবে ফেসবুকে বুদ্ধিজীবি সেজে পান্ডিত্য ঝাড়েন কেন?

যারা মনে করেন গুলি খাওয়া ছাড়া মালালার কোন অবদান নেই, তারা বোধ হয় জানেনও না, গুলি খাওয়ার তিন বছর আগে – মাত্র ১১ বছর বয়সে বিবিসি সাইটে মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং তালিবানদের প্রচারণার বিরুদ্ধে ব্লগিং শুরু করেছিলেন মালালা। তখনই মৃত্যু হুমকি পেয়েছিলেন অজস্র। তার লেখায় এমনই আক্রান্ত বোধ করেছিলো তালিবানি জঙ্গিরা যে, যে বাসে করে মালালা স্কুল থেকে ফিরতো সেখানে হামলা করে। বাসে উঠে রাইফেল তাগ করে তার সহপাঠীদের বাধ্য করা হয় বাসের মধ্যে মালালা কোন্‌ জন সেটা চিনিয়ে দিতে। সহপাঠীদের একজন ভয় পেয়ে চিনিয়ে দিলে তৎক্ষণাৎ মালালাকে গুলি করা হয়।

তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরেও তিন দিন মালালা সংজ্ঞাহীন ছিল। জ্ঞান ফিরেছিলো ইংল্যান্ডে নেয়ার পর। সেখানে সার্জারি করে তার গলার কাছ থেকে বুলেট অপসারণ করা হয়েছিল, এমনকি মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ থামাতে খুলির কিছু অংশ কেটে বাদ দিতেও হয়েছিল।

যারা মালালাকে আজ উঠতে বসতে গাল দিচ্ছেন, তাদের কেউ কি অনুধাবন করতে পারছেন মাত্র ১১ বছর বয়সেই কি রকম ‘চাইল্ডহুড ট্রমা’র মধ্যে দিয়ে মেয়েটাকে যেতে হয়েছিল? শুধু এই কারণেই তো মালালা শ্রদ্ধা পেতে পারেন। তার আগের কিংবা পরের কাজ এবং পুরস্কারগুলো যেমন, নারীশিক্ষার জন্য মালালা ফাণ্ড গঠন, মৌলবাদ বিরোধিতা, ২০১৩ সালে ইউএন এ তার ঐতিহাসিক বক্তৃতা, ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন’স পিস প্রাইজের জন্য ডেসমণ্ড টুটুর নমিনেশন, ‘টাইম ম্যাগাজিনের ২০১৩ সালের ‘অন্যতম প্রভাববিস্তারকারী ব্যক্তি’ নির্বাচিত হওয়া – সেগুলো না হয় বাদই দিলাম।

কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, মালালা কোথায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে? তাদের কাছে বিষয়টা এরকম যে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটা দৃশ্যমান গুণগত পরিবর্তন দেখা যেতে হবে। সেটা কিছু ক্ষেত্রে হয় তো ঠিক আছে। কিন্তু একজন মানুষের একটি ছোট বা বড় কাজের অদৃশ্য যে ব্যাপক গুণগত ভূমিকা সেটা চোখের দেখায় দেখলে হবে না, মস্তিষ্ক দিয়ে বুঝতে হবে।

ঠিক সেই কাজটাই করেছেন মালালা ইউসুফজাই। মেয়েদের শিক্ষার জন্য তার যে সংগ্রাম সেটা এমনকি বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা এলাকা ভুরুঙ্গামারিতে কাজ করতে গিয়েও বোঝা যাবে না। সেটা ঢাকার কোনো ফাইভস্টার হোটেলে জঙ্গিবাদবিরোধী কর্মশালাতে বসেও বোঝা সম্ভব না। তার সংগ্রামটা বুঝতে হলে ‘বর্বর’ পাকিস্তানের ‘বর্বরতম’ এলাকা সোয়াত উপত্যকাতেই যেতে হবে। একটা বাচ্চা মেয়ের বুকে কতোটা সাহস থাকলে সেখানে বসে সে তালেবানদের চ্যালেঞ্জ করে মেয়েদের শিক্ষার জন্য কাজ করতে পারে, সেটা বুঝতে হলে তার সাহস নিয়ে তোলা প্রশ্নকর্তাদের সেখানেই পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। অথবা তালেবানদের নতুন কাজিন কথিত ইসলামিক স্টেট, আইএসের ছুরির নীচে।

আইএস কাউকে কতল করার যে ভিডিও পাঠায়, তার ছোট্ট সংগ্রামে মালালা সবসময়ই ওইরকম অদৃশ্য ছুরির নীচে ছিলো। সেটা যে শুধু কাল্পনিক হমকি ছিলো না, সেটা তার মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাই প্রমাণ করে। আপনি কল্পনা করুন যে, কিরকম বর্বরদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মালালা মেয়েদের শিক্ষার জন্য তার সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছিলো, যে বর্বররা ১৫ বছরের একটা বাচ্চার মাথায় গুলি চালিয়ে দিতে পারে। যারা তার নোবেল নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তারা নিশ্চয়ই বলবেন না, মার্কিনী পানিপড়া দিয়ে নিজের মাথা মুড়িয়ে রেখেছিলো মালালা, তাই ‍তালেবানের বুলেট তাকে মেরে ফেলতে পারে নি।

তালেবানের ঘাঁটিতে বসে তালেবানকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সাহস দেখিয়েছে মালালা। তবে সে শুধু সেখানেই থেমে থাকে নি। অসম্ভব প্রাণশক্তি দিয়ে আবার জীবনে ফিরে এসে সে তার নতুন লড়াইটাও চালিয়ে যাচ্ছে। মালালার সাহস ও অঙ্গীকার এভাবে সার্বজনীনতা পেয়েছে যেখানে জঙ্গিবাদকে চ্যালেঞ্জ জানানোর নতুন অস্ত্র হয়েছে শিক্ষা, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা। সেটা যে শুধু বর্বর পাকিস্তানের জন্য, তা না; সারাবিশ্বের জন্যই।

পন্ডিতদের আলোচনার শানে নূযুল এরকমই মনে হচ্ছে। এমনকি তারাও আছেন যারা মার্কিন বা ব্রিটিশদের কোম্পানিতে ফুট-ফরমাশ খাটেন আর নোবেল পুরস্কারকে সারাক্ষণ মার্কিনীদের পাতানো খেলা বলে মুখে ফেনা তুলেন। ভাই একটু থামেন। আপনার কথায় আমি একমত। নোবেল হচ্ছে মার্কিনীদের এক মহা প্রহসন। তা হলে ভাইজান, সেটা মালালা পেলো নাকি উ-লা-লার সঙ্গে উদ্দ‍াম নাচ নেচে বিদ্যিয়া বালান; সেটা নিয়ে ‍আমাদের এতো টেনশন কেনো? সেটা মালালা পেলেও যা, ঝামেলা পেলেও তা। এ নিয়ে তা হলে কথা বাড়ানোর মাজেযা কী? চুপ যান। আপনার পান্ডিত্য নিয়ে আপনি থাকেন।

মালালাকে নোবেল দেওয়ার জন্য নোবেল কমিটি কিংবা মালালাকে সামনে পেলে তাকেই ছিড়েখুঁড়ে চিড়েচ্যাপ্টা করে দেওয়ার যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে যে ক্লিন-শেভড অথবা মুস্টাচ ম্যানরা গোঁফে তা দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা মালালার নোবেলকে পশ্চিমাদের ‘সাপ হয়ে দংশন আর ওঝা হয়ে ঝাড়া’র তত্ত্বে ফেলছেন।  

তা হলে ওই ছেলেটির গল্প শুনুন। অংকে ১০০-তে ১০০ পেয়েছে সে। মাকে বলার পর মা বললেন, কিন্তু আরো তিনজনতো ১০০ পেয়েছে। ছেলেটির তখন উত্তর ছিলো, মা- আমার কাজ আমি করেছি, ১০০-তে ১০০ পেয়েছি। এখন অন্যরাও যদি ১০০ পায় সেটা তো আমি আটকে রাখতে পারবো না।

ঠিক যে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন এমন অনেকেই হয় তো নোবেল পান না। কিন্তু যিনি পেয়েছেন তাঁর কাজকে আপনি কিভাবে অবজ্ঞা করবেন! 

আপনার কি আছে মালালার মত সাহস? তালেবানের ছুরির নীচে বসে তাদেরকে লাথি মারার?

পুনশ্চঃ পাকিস্তান থেকে এ পর্যন্ত তিনজন নোবেল পেয়েছেন। প্রফেসর মোঃ আব্দুস সালাম ১৯৭৯ সালে নোবেল পেয়েছিলেন পদার্থ বিজ্ঞানে। তবে এই কাদিয়ানীর পরিচয় দিতে সাধারণ পাকিস্তানীরা গর্বের বদলে বরং লজ্জাবোধ করে সম্ভবতঃ। বছর কয়েক আগে ডন পত্রিকায় দেখেছিলাম ডঃ সালামের কবরের এপিটাফটা ভেঙ্গে দিয়েছে তাঁর গ্রামবাসীরা। ১৯৯৬ সালে মৃত্যুর পর অন্তিম ইচ্ছায় তিনি নিজের গ্রামেই সমাধিস্থ হয়েছিলেন। তাঁর এপিটাফে লেখা ছিলো first muslim nobel laureate – মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার গ্রামবাসী তা উপড়ে ফেলেছিলো। পরে কোর্টের আদেশে তা পুনর্বহাল করা হয় – তবে মাঝখানের একটি শব্দ মুছে দিয়েঃ “first ______ nobel laureate”  

আবছা মনে পড়ছে ৯০-এর দশকে ডঃ সালাম একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। আয়রণিকালী, তার ভ্রমণের কিছুদিন পরেই আহমদীয়াদের অমুসলিম ঘোষণার দাবীতে কাঠমোল্লারা বায়তুল মোকাররমে প্রচুর হাঙামা করেছিলো। 

এছাড়া, পাকিস্তানী বায়োকেমিস্ট ডঃ হরগোবিন্দ খুরানা ৭০ এর দশকে নোবেল জিতেছিলেন। তিনি পাকিদের গর্বের তালিকায় আসেন না এক ধর্মীয় পরিচয়ের কারনেই। পাকিরা সবসময় সবকিছুর উর্দ্ধে ধর্মীয় পরিচয় কে বিবেচনা করে।

এসব দেশে বিজ্ঞানী বা সমাজকর্মী হয়ে জন্মানোই মনে হয় পাপ। বর্বর পাকিরা না হয় এদের মেনে নিতে পারে না কিন্তু বাংলাদেশের নব্য ফেসবুকীয় পন্ডিতদের মন মানসিকতা কোন পর্যায়ে?

[Pic, CC BY 2.0]

Related Posts

DUCSU election 2025

Was this unexpected victory of Shibir in the DUCSU election actually expected?

At Dhaka University, Shibir is winning simply by securing votes – that’s the reality. AcrossRead More

DUCSU Election 2025 and Shibir

ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের এই অপ্রত্যাশিত বিজয় কি প্রত্যাশিতই ছিল?

ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে শিবির ভোট পেয়েই জিতছে, এটাই বাস্তবতা। বাংলাদেশের সবক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্ট কিছু না কিছু ভুলRead More

15 February 1996 Election

১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন – বি এন পি যেভাবে গনতন্ত্র ধ্বংস করেছিল

২০২৪ এর ঐতিহাসিক গণ-অভভুত্থানের আগে ১৯৯০ সালে ছাত্র জনতার ত্যাগের বিনিময়ে দেশে গণতন্ত্র বিকাশের যেRead More

Comments are Closed