Cognitive Domains of Learning
শিক্ষাব্যবস্থা, মুখস্ত করার জন্য চাপ প্রয়োগ ও বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীলতার দৈণ্যদশা !
আমরা যখন দশম শ্রেনীতে পড়ি তখন একজন শিক্ষক ছিলেন আমাদের যিনি সাধারন বিজ্ঞান পড়াতেন। উনি চেয়ারে এসে বসতেন, এক ছাত্র বইটি এগিয়ে দিত। উনি ২/৩ পৃষ্ঠা রিডিং পড়তেন। এমনকি ‘চিত্র নম্বর ৯’, ‘এসো নিজে করি ৭.২’ এগুলোও পড়তেন। কোনদিন ব্লাকবোর্ডে যাওয়া তো দূরে থাক মুখেও কোনকিছু বোঝাতেন না। রাজনীতি নিয়ে থাকতেন ব্যস্ত। পরবর্তীতে স্কুলের প্রধানও হয়েছিলেন। এটি একজন শিক্ষক ও স্কুল ব্যবস্থাপনার চিত্র। আমাদের এক ক্লাসমেট ছিল ২ টা বৃত্তি পাওয়া। সে স্কুলের শিক্ষক হতে পারেনি, পেরেছিল রাজনীতি করা এক অদক্ষ ছেলে। গ্রামের সব স্কুলগুলোতেই এখন শিক্ষক নিয়োগ হয় টাকার বিনিময়ে। সেখানে কোথায় মেধার বিচার, কোথায় সততার পুরষ্কার ?
আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল মুখস্ত করা। আমাদের দেশের বাচ্চাদের ছোট থাকতেই বোঝানো হয় লেখাপড়া মানে বই মুখস্থ করা। ছোট থাকতে দেখেছি দক্ষিন অঞ্চল থেকে বহু ছাত্র আমাদের গ্রামে লজিং থাকত। মাঝে মাঝে শুনতাম তারা বলত তাদের ছাত্রের কারো মাথা খুব ভাল কারন সে সব মুখস্ত করতে পারে, আবার কারো মাথা খারাপ কারন সে মুখস্ত করতে পারে না। এই মুখস্ত জিনিসটা আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মনে শিক্ষা সম্পর্কে একটা ভীতি তৈরি করে। অবশ্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষক, চাকুরি পরীক্ষা সব এই মুখস্ত কে প্রোমোট করে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও দেখেছি অনেক শিক্ষক মুখস্ত লেখাকে না বুঝে বেশী নাম্বার দেন।
শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং মুখস্থনির্ভর শিক্ষা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি অবস্থান। শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইনডিপেনডেন্ট লারনার তৈরি করা, বাংলা করলে যেটা দাঁড়ায় স্বাধীন শিখিয়ে। সেটা কী রকম? নিচু শ্রেণিতে যোগ শিখলেন, বিয়োগ শিখলেন, আরেকটু উঁচু শ্রেণিতে ওঠার পর সরলটা যেন আপনি নিজেই করতে পারেন। মানে, শিক্ষা হচ্ছে এমন একটা টুলস বা মেকানিজম, যেটা আপনাকে জীবনভর সহযোগিতা করবে নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে। আপনার একটা ধাপের শিক্ষা আপনাকে সহযোগিতা করবে পরের ধাপে স্বাধীনভাবে অন্য কিছু শিখতে। শিক্ষা মানে আপনি সব কিছু সম্পর্কে জানবেন এটা নয়, আপনি যা জানেন না তা কিভাবে জানতে হয় এই কৌশল জানাটাই শিক্ষা। শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবসভ্যতার জ্ঞানজগতের বিভিন্ন স্তরে আপনি যেন স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারেন, আপনাকে সেই দক্ষতাটা দিয়ে দেওয়া। এই ধাপে ধাপে এগোনোর মধ্যে দিয়েই ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ নিশ্চিত হয়। এখন একজন শিক্ষার্থী যখনই শুধু মুখস্থ করার মধ্যে আটকে থাকে, তখন তার অন্য সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ (কগনেটিভ ডেভেলপমেন্ট) আটকে যায়।
শিক্ষাবিজ্ঞানে ব্লুমস বলে একজন ভদ্রলোকের কগনেটিভ ডোমেইনের ছয়টি ভাগের কথা মোটামুটি শুনে থাকবেন। সেইটা কী রকম?
- প্রথমে একজন শিক্ষার্থী কোনো একটি বিষয় পড়ল, মানে প্রাপ্ত তথ্যগুলো মনে রাখল (রিমেম্বারিং),
- পরের ধাপে শিক্ষার্থী যেটুকু পড়ল সেটুকু বুঝবে (আন্ডারস্টান্ডিং),
- তার পরের ধাপে গিয়ে শিক্ষার্থী যেটুকু পড়ল, সেটা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারার দক্ষতা অর্জন করবে (অ্যাপ্লায়িং),
- এর পরের ধাপে গিয়ে শিক্ষার্থী সেই যে পঠিত বিষয়বস্তু বা একই ধরনের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করতে পারবে (অ্যানালাইজিং),
- তারও পরের ধাপে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন করতে পারবে (ইভ্যালুয়েটিং) এবং সর্বোচ্চ ধাপে গিয়ে শিক্ষার মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থী নতুন কিছু সৃষ্টি করার দক্ষতা অর্জন করবে (ক্রিয়েটিং)।
শিক্ষাবিজ্ঞান অনুযায়ী শিক্ষা একজন ব্যক্তিকে সরল থেকে জটিলে ভাবতে সাহায্য করবে। সহজ থেকে কঠিনে বুঝতে সাহায্য করবে। মনে রাখা, মেমোরাইজেশন বা মুখস্থ বিদ্যা হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের একদম প্রথম এবং নিম্নতম স্তর। এরপর আরও পাঁচটি স্তর রয়ে যাচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের। আমাদের সমস্ত শিক্ষাব্যবস্থা বছরের পর বছর ধরে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সবচেয়ে নিম্নস্তরকে এবং প্রাথমিক স্তর মানে মুখস্থ বিদ্যাকেই ক্রমাগত প্রোমোট করে যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের উচ্চতর সব কটি স্তর রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই যখন ব্যবস্থার অবস্থা, তখন সেই ব্যবস্থার ভেতর থেকে চিন্তাশীল মানুষ বের হবে, এটা আমরা আশা করি কীভাবে?
বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের একদম প্রথম এবং নিম্নতম স্তরে থাকা এই লোকগুলোর কাছ থেকে কি বেশী কিছু আশা করা ঠিক ? এরা ২ দিন পর পর প্রশ্ন ফাঁসের জন্য ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দিবে, ইন্টারনেট বন্ধ করে দিবে, যে স্কুলে টয়লেট নেই সেখানে চলন্ত সিঁড়ি লাগানোর সুপারিশ করবে, ১০০০ টাকার ফ্যান ১০০০০০ টাকায় কিনবে, রাস্তা তৈরির ব্যায়ে ভারত, আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড কে হারিয়ে দিবে, পিত্তথলির পাথর অপারেশন করতে গিয়ে কিডনিতে ছিদ্র করে দিবে, ১ টি ররাদ্দ গাড়ির বদলে পরিবারের সবার জন্য ১ টি করে সরকারী গাড়ি ব্যবহার করবে, সরু রাস্তায় আলাদা লেন করে নিজদের যাত্রা সুগম করবে, লোহার পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করে বিল্ডিং বানাবে, মৃত রোগী আটকে রেখে স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিবে, আরো কত কি !
তবে বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরের শেষ স্তরে পৌঁছানো কেউ কি নেই ? আছে, তারা স্রোতে মিশতে না পেরে কেউ বিদেশ চলে গিয়ে বিজ্ঞানী, গবেষক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার হয় আর যারা দেশে থাকে তারা সংখ্যায় এত নগণ্য যে সংখাগরিষ্ঠদের চাপে, তাপে পুড়ে নিঃশেষ হয়। তাদের এই সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানোর জন্য রাষ্ট্রের বা শিক্ষা ব্যবস্থার কোন অবদান নেই। এটা একান্তই তাদের ব্যক্তিগত একাগ্রতা ও নিষ্ঠার ফল।
মুখস্থ করে আমাদের সমস্ত শিক্ষাজীবন তো পার হয়, চাকরির বাজারের কী অবস্থা? বিসিএস থেকে শুরু করে ব্যাংকের চাকরি, প্রতিটি সরকারি চাকরির পরীক্ষার জন্য গাইড পাওয়া যায় নীলক্ষেতে। সরকারি বাদ দেন, বেসরকারি শিক্ষকতা চাকরির জন্যও গাইড বই কিনতে পাওয়া যায়। বিসিএসে যে শিক্ষার্থী পুরো গাইড বই মুখস্থ, কণ্ঠস্থ করে ফেলতে পারবে, তাঁর বিসিএসে চান্স পাওয়ার সম্ভাবনা মোটামুটি ৯০ শতাংশ। ওই জন্য বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অসংখ্য ছেলেমেয়েকে দেখবেন, প্রথম বর্ষ থেকেই বিসিএসের গাইড বই মুখস্থ করা শুরু করে দেন। এই মুখস্থনির্ভর ভালো ফলের চক্র চলতে থাকে শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে জীবনধারণের জন্য একটা চাকরি জোগানো পর্যন্ত। এরা গঠনমূলক কি দিবে দেশের জন্য? ইংরেজ আমলের সেই কেরানীগিরির মানসিকতা থেকে তারা তো মুক্ত হতে পারে না।
এখন তাহলে শিক্ষার্থীদের মানুষের মতো মানুষ বা নীতিবান মানুষ বানাতে হলে আসলে কী করতে হবে? এই জায়গা থেকেই আপনার মনে হবে বা অনেক বোদ্ধা ব্যক্তিও বলে থাকেন, স্কুলপর্যায় থেকে নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। অন্য বিষয়ের মতোই ছাত্ররা যদি নৈতিক শিক্ষাও মুখস্থ করে পরীক্ষায় ১০০-তে ৯০ পেয়ে পাস করে, তাহলে? কী মনে হয়, নৈতিক শিক্ষাও যদি ছাত্ররা কোনো কিছু না বুঝে স্রেফ মুখস্থ করেই পাস করে, তাহলে সেই শির্ক্ষাথীরও তো চোর হওয়ার সম্ভাবনাই থেকে যায়, নাকি? তাহলে সমস্যাটা কোথায়? বর্তমানে অনেক ডক্টরেট করা লোকও আমাদের দেশে বিরাট মাপের চোর হন। তাঁর শিক্ষা তাঁকে চুরি করা থেকে আটকাতে পারে না। বিসিএস পাস করার পর একটা বিশাল অংশের সরকারি কর্মকর্তা আসলে মনেই করেন চুরি করার পারমিট পেয়ে গেলেন। যে কারণে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর এত উচ্চশিক্ষিত একজন মানুষ লোহার পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করার মধ্যে কোনো সমস্যা দেখেন না। যে কারণে ডাক্তারি পাস করার পর হাজার হাজার শিক্ষিত ডাক্তার টাকার জন্য রোগী আটকে রাখার মধ্যে কোনো সমস্যা দেখেন না। তার মানে এটা প্রমাণিত যে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা মানুষের মতো মানুষ বা নীতিবান মানুষ তৈরি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ?
আমাদের দেশের শিক্ষক, প্রশাসক, ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, জনপ্রতিনিধি নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই উপযুক্ত নয়। এখানে শিক্ষার সেই প্রথম স্তরের চিন্তা করেই প্রশ্ন করা হয়, মূল্যায়ন করা হয়, পদ্ধতিটাও সাজানো হয় সেভাবেই। এই প্রক্রিয়া, পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। সততা, দক্ষতা, মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এসবকে যতদিন নিয়োগের মাপকাঠি না করা হবে ততদিন এদেশের কোন ভাল পরিবর্তন হবে না। পদায়ন করতে হবে শিক্ষার শেষ স্তরে পৌঁছানো মানুষজনকে যারা নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারে তার ডোমেইনে। না হলে এই ভয়ংকর চক্র চলবে বৃত্তাকারে, শেষ হবে না কোনদিন। টাকা হবে দু’পেয়ে প্রাণীগুলোর কিন্ত মানুষ হবে না।
[PC: © CC BY-SA 4.0 ]
Related Posts
বুগান্ডার জরুরী সেবা 999 নাম্বারের গল্প এটা ! অবিশ্বাস্য সেবার উদাহরণ !
অনেক গল্প আছে, তবে এটা সেগুলোর একটি মাত্র। জরুরী সেবা যে কতভাবে, আন্তরিকভাবে মানুষের সমস্যাRead More
‘একটি জাতির জন্ম’ – জেলারেল জিয়াউর রহমানের লেখা প্রবন্ধ
‘একটি জাতির জন্ম’ নামে জেনারেল জিয়া ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকার ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ সংখ্যায় একটিRead More
সব বই মানুষকে আলোকিত করে না, আলোকিত করে আলোকিত মানুষ
প্রিন্টিং প্রেস আবিষ্কারের পরে ইউরোপের সেই সময়ের সর্বাধিক পঠিত বই ছিল কিভাবে “উইচ হান্ট” করে-Read More
Comments are Closed