
Bengali New Year
বাঙালির সার্বজনীন পহেলা বৈশাখের সঙ্গে কোন ধর্মীয় যোগসূত্র নেই
বাংলা সালের সঙ্গে কোন ধর্মীয় বিষয় যুক্ত নেই, এটা সম্রাট আকবরও প্রবর্তন করেননি, তিনি খাজনা আদায়ের স্বার্থে কিছু পদ্ধতিগত সংস্কার করেছিলেন মাত্র । এটা হাজার বছর ধরে বাংলার ফসলী সাল হিসাবে চর্চিত হয়ে আসছে। শুধু এই অঞ্চলে নয়, নেপাল, ভারত, বার্মা, লাওস, কম্বোডিয়া, চীনের এক অংশ, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ আরো অনেক দেশে পহেলা বৈশাখ পালিত হয় ভিন্ন নামে, ভিন্ন আবহে।
অনেক গোঁড়া লোকজন পহেলা বৈশাখ কে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে নিষিদ্ধ, অপসংস্কৃতি বলে। তাদের একটি যুক্তি হল বৈশাখ নামটি এসেছে সনাতন বিশাখা নাম থেকে। এ জন্য এটি ধর্মীয় দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। এই যে তারা ‘অপসংস্কৃতি’ শব্দটি ব্যবহার করে সেটা বাংলা ভাষার একটি নতুন শব্দ। শব্দটির স্রষ্টা ডঃ হুমায়ুন আজাদ যিনি আবার ধর্ম কর্ম বিশ্বাসই করতেন না। তো এই মানুষটির উদ্ভাবিত শব্দ ব্যবহারের দোষ নেই, দোষ হল শত শত বছর পূর্বে বাংলা ভাষায় প্রবিষ্ট কোন শব্দ যা এখন বাংলা ভাষার অংশ হয়ে গেছে।
ভাষা পরিবর্তনশীল। এক ভাষায় অন্য ভাষার অনেক শব্দ প্রবেশ করে। কোন শব্দ কোন ভাষা থেকে বা সূত্র থেকে এসেছে সেটা বড় কথা নয়। সেটা একবার ভাষার অংশ হয়ে গেলে তার সঙ্গে আর কোন সাম্প্রদায়িক সম্পৃক্ততা থাকে না। বৈশাখ শব্দের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছে বা সোম মঙ্গল এসব শব্দ কিভাবে এসেছে তার চেয়ে বড় হল এগুলো বাংলা ভাষায় মিশে গেছে । আপনি যখন বলেন মঙ্গল বার তখন কি আপনার মনে হয় সেটা মঙ্গল গ্রহের নামে নাম, একটি গ্রহের নামে বারের নাম হবে কেন ? আপনার বাড়ি কালীগঞ্জ বা গাজীপুর বলে আপনি আপনার এলাকার নাম পরিবর্তন করে ফেলবেন ? কোথাও আর পরিচয় দিবেন না ? কালীগঞ্জ ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের জন্য কোন অনুদান দিবেন না ? কালীগঞ্জের কোন উৎসবে যোগ দিবেন না ? নামের উৎস খুঁজে একটা শতাব্দি প্রাচীন বাংলা শব্দকে সাম্প্রদায়িক ট্যাগ লাগানো নিতান্তই শিশুসুলভ। প্যাগান দের থেকে অনেক শব্দ এ্যারাবিকে স্থায়ী হয়েছে। প্যাগান কারা জানেন তো ? না জানলে গুগল করুন।
রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ …’ নিয়েও তাদের সমস্যার অন্ত নেই। একজন কবি কতকিছুর সঙ্গে উপমা দেন। মানুষ বলে তোমার জীবন হোক ফুলের মত। তার মানে কি আপনি ফুল হয়ে যাবেন ? এসো হে বৈশাখ গানের সম্পূর্ণ কথা আপনি শুনেছেন ? কামনা করা হয় ফুলের মত সুন্দর হবে জীবন। প্রজাপতি তুমি কোথায় পেলে এমন রঙিন পাখা ! এখন প্রজাপতির কাছে রঙিন পাখা মানুষ চাইলে সেটা তো আর পূরন হবে না, মানুষ বলতে পারে তার জীবনেও যেন এমন কোন রঙিন কিছু আসে। এসো হে বৈশাখ বলে রবীন্দ্রনাথ দেবীর কাছে প্রার্থনা করেছে কোন রেফারেন্সে পেলেন আপনি ? ব্লগস্পটের সাইট কোন রেফারেন্স হতে পারে না। রেফারেন্স হতে গেলে তাকে কিছু যোগ্যতা পূরন করতে হয়। ‘আমি রাত কে বলেছি কাল ডাকতে আমায় ভোর হবার আগে’ রাত তাকে ডেকে দিবে ? কিন্তু এটা দিয়ে তিনি প্রত্যাশা করেছেন তিনিও সকালে উঠে যাবেন ভোর হবার আগে। প্লিজ বেশী করে পড়ুন। কেউ কিছু লিখে দিল, আর সেটা বিশ্বাস করার আগে একটু ঘাটুন সে বিষয়ে বিজ্ঞজনেরা কি বলেছেন। নিজের কমন সেন্স প্রয়োগ করুন।
পহেলা বৌশাখে কি কোন ধর্মের মানুষ আলাদা করে কোন ধর্মীয় আচার পালন করে ? আমি তো আমার জিন্দেগীতে দেখিনি। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে পালন করে অনেক জায়গায়। তবে পহেলা বৈশাখ সম্পূর্ণ বাঙালি জাতির উৎসব। কেউ মঙ্গল শোভাযাত্রা করুক বা না করুক, কেউ পান্তা ইলিশ খাক বা না খাক তাতে পহেলা বৈশাখের সার্বজনীনতা খর্ব হবে কেন ? মূঘলদের চাপিয়ে দেয়া হিজরি সনই মেনে চলা হত এখানে। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল। দেখা যায় এখন এই সময়ে, এই আবহাওয়ায়, এই ঋতুতে হিজরি যে মাস ৪ বছর পরে সে মাস আর থাকবে না। হিজরি বছর সৌর বছরের চেয়ে ১০/১১ দিন কম। এ অঞ্চলের ফসল ফলত ঋতুর উপর নির্ভর করে। ঋতু আবর্তিত হয় সৌর সন অনুয়ায়ী, চন্দ্র সন অনুযায়ী নয়। হিজরি সনের হিসাবে খাজনা আদায়ে সমস্যা দেখা দিত। ধরুন হিজরি ৩ নং মাসে খাজনা আদায় করা হল এ বছর যখন কৃষকের ঘরে ফসল উঠল। ১০ বছর পরে হিজরি সেই একই মাসে এখানে শীতকাল। তাহলে কৃষক সবে ফসল বুনেছে তখন। সে সময়ে তার পক্ষে খাজনা দেয়া সম্ভব ? এমন অনেক বাস্তবতার মুখে সম্রাট আকবর আগে থেকেই প্রচলিত বাংলা সন নতুন করে সাজিয়ে মেনে নেন।
কোন কালচার এ্যারাবিক রিজিওনে না থাকলেই সেটা ধর্মের বিরুদ্ধে চলে যাবে ? পহেলা বৈশাখ ভিন্ন নামে নেপালে, চীনের কিছু অংশে, থাইল্যান্ডে, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, লাওস অনেক দেশে পালিত হয়। সবচেয়ে বড় আকারে পালিত হয় থাইল্যান্ডে সংক্রান নামে। আপনি জানেন আমাদের দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে সাংগ্রাই নামে পালিত হয়। চৈত্র সংক্রান্তির কথা তো জানেন। তাহলে বুঝতেই পারছেন সংক্রান্তি > সাংগ্রাই > সংক্রান শব্দগুলোর উৎপত্তি কোন এক আদি শব্দ থেকে। সংস্কৃতিও এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে মিশে যায়। এক সময় সে দেশের সংস্কৃতির অংশ হয়ে যায়। এখানে প্রত্যেক দেশের সংখাগুরু মানুষের ধর্মের পার্থক্য কিন্তু জানা আমাদের। অথচ, এই উৎসব সবাই করছে যে যার মত করে। বাংলা নববর্ষ পালনে এত সমস্যা কোথায় তাহলে ?
ভাষা, সংস্কৃতি কোন অঞ্চলের মানুষের জাতিসত্ত্বা গঠন করে। এর সঙ্গে আসলে ধর্মের কোন সম্পর্কে নেই। আমরা কিন্তু এভাবেই জানি। জার্মানিতে মুসলিম, খ্রীস্টান, হিন্দু যত মানুষই থাক না কেন যারা জার্মান ভাষায় কথা বলে, একই সংস্কৃতির অংশ তারা সবাই জার্মান। তেমনিভাবে জাপানিজ, চাইনিজ, ইংলিশ অনেক জাতিসত্ত্বা আছে। আমরা বাঙালি। ভাষা ও সংস্কৃতিই আমাদের এই বাঙালি পরিচয় দিয়েছে। পহেলা বৈশাখ বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে গেছে। একজন মুসলিম ছেলে তার জন্মদিনে মসজিদে গিয়ে প্রার্থনা করতে পারে, একজন হিন্দু মন্দিরে যেয়ে প্রার্থনা করতে পারে। কিন্তু তার জন্য তো আমরা বলতে পারি না কারো জন্মদিন পালন সাম্প্রদায়িক। পহেলা বৈশাখে কে কি করল সেটা বিবেচ্য নয়। কেউ পহেলা বৈশাখে তার নিজের ধর্ম মেনে সৃষ্টিকর্তার কাছে সারাবছরের সুখ শান্তির জন্য প্রার্থনা করতেই পারে। এর মানে এই নয় যে পহেলা বৈশাখ হতে হলে নির্দিষ্ট কোন মানুষের ধর্মীয় আচার পালন করতেই হবে বা কেউ তার নিজস্ব ধর্মীয় আচার পালন করলেও নববর্ষ তার সার্বজনীনতা হারাবে। যার যার ধর্ম মেনে কেউ বছরের প্রথম দিনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতেই পারে। আপনিও করুন, এতে তো দোষের কিছু নেই।
পহেলা বৈশাখে আমি আমার জীবনে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের আচার পালন করতে দেখিনি সার্বজনীন ভাবে। কি হয় ? ঢাকায় দেখি হাজার হাজার মানুষ রমনা পার্কে গিয়ে ঘোরাঘুরি করে, আড্ডা দেয়। পরিবার, বন্ধু বান্ধব সবাই মিলে অনেক কষ্ট করেই যায়। সেখানে কোন ধর্মীও আচার তো হয় না। মানুষের প্রাণের মিলন ঘটে। এ এক মহা মিলনমেলা। মানু্ষ সকল ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে মিশে যায়। আর এ বছর যেভাবে মানুষ বেরিয়েছে তাতে গোঁড়াদের মুখে ভালই চুন – কালি পড়েছে। দেশে নাটক হচ্ছে, সিনেমা বানানো হচ্ছে, যাত্রা চলছে, কনসার্ট চলে। তাহলে পহেলা বৈশাখ নিয়ে এত আপত্তি কেন ? পহেলা বৈশাখ তো সুস্থ সংস্কৃতি, কোনভাবেই অপসংস্কৃতি নয়। মেয়েরা তো শাড়িই পরে। শাড়ি তো বাঙালি নারীর শ্বাশত পোষাক। শাড়িতে তো কোন অশ্লীলতা নেই। যারা পহেলা বৈশাখ কে বেলেল্লাপনা বলে তারা কোন যুক্তিতে বলে আমার মাথায় আসে না। পহেলা বৈশাখ কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পারিবারিক ভাবে পালন করে মানুষ। এক পরিবারের সবাই একসঙ্গে যায় ঘুরতে।
গোঁড়ামি করলে কত কিছু নিয়েই করা যায়। এটা যার যার দৃষ্টিভংগি, শিক্ষা, মানবতা, সভ্যতা, শিষ্টাচার এসবের উপর নির্ভর করে।
কি জানি, আমি হয়ত কম জানি, তাই আমি তেমন দোষের কিছু দেখি না। গোঁড়াদের হয়ত বেশী জানা থাকতে পারে। তবে আমার বিবেচনায় আমাদের বাঙালি জাতির একটি অন্তত সার্বজনীন উৎসব থাকা উচিৎ যা আমাদের বাঙালিরা সবাই মিলে উৎযাপন করতে পারব। বিশ্বের সকল প্রান্তের সব বাঙালি সে উৎসব করবে। এখন পর্যন্ত এক পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষই আছে সেটা। বিশ্বের প্রায় সকল জাতিই তাদের নববর্ষ ধুমধাম করে পালন করে, আমাদের জন্য সমস্যা তৈরি করে কেন শুধু ?
[ ছবিঃ Labib Ittihadul, CC BY 2.0 ]
Related Posts

In the Shadow of Famine: Bengali Food Habits – History, Practice, and Bodily Burden
About 10-12 days ago.I went to a large wholesale store, where products are usually soldRead More

দূর্ভিক্ষের ছায়ায় বাঙালির খাদ্যাভ্যাসঃ ইতিহাস, অভ্যাস ও শরীরের দায়
প্রায় ১০-১২ দিন আগের ঘটনা। একটি বড় বিপণিবিতানে গিয়েছিলাম, যেখানে সাধারণত বক্স ধরে পণ্য কিনতেRead More

Are religion, country, race, patriotism, and nationalism all racist concepts?
The only uncontacted human tribe left in the world today are the Sentinelese of NorthRead More
Comments are Closed