
All Works are Honorable
কোন কাজই ছোট না, সব কাজকেই সম্মান করতে শিখুন
আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন নয় বছর বয়সে তার মাকে হারান। খুব অল্প বয়সেই দরিদ্র পরিবারের হাল ধরেন। কখনো নৌকা চালিয়ে, আবার কখনো কাঠ কেটেও সংসার চালিয়েছেন তিনি। তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের অতীতে শরবত বিক্রি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চা বিক্রি, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর ফার্নিচারের দোকানের কর্মচারী থাকা, ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর বাস চালানো, ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের খেতমজুরের কাজ ইত্যাদির কথা সবারই জানা। এ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস থেকে শুরু করে আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস, কে নেই তালিকায়? বিশ্বে অনেক মনীষী ছিলেন সাধারণ পেশাজীবী পরিবারের সন্তান। কৃষক, মুচি, ঝাড়ুদার ও সমাজের ক্ষুদ্র পেশা থেকে প্রেসিডেন্ট, বিশ্ববিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন-এমন অসংখ্য নজির রয়েছে।
আমি এখন যেই শহরে কাজ করি সেখানে বাংলাদেশের অনেক রথী-মহারথীকে দেখি এমন সব কাজ করছে যা দেশে থাকলে তারা করার কথা কল্পনায়ই আনতেন না। এখানে সব পেশার মানুষের গুরুত্ব সমান, কেউ কারো থেকে কম নয়। সবাইকে সবাই স্যার বলে প্রয়োজনে, আমাকে রাস্তঘাটে কত পুলিশ অফিসার, অচেনা মানুষজন স্যার বলেছে কতদিন। অথচ বাংলাদেশে দেখুন! পেশা, পদবী, ক্ষমতার কত বাহার। কে কাকে ‘স্যার’ বলবে, কোন পেশার মানুষ বেশী সম্মান পাবে এসব সেখানে নির্ধারিত। পেশা ভেদে মানুষের সম্মান নির্ভর করে দেশে।
যে মানুষটির স্ত্রীনশট দিয়েছি তিনি আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড লিস্টে আছেন। ৫০০০ ফ্রেন্ড, ১১০০০ ফলোয়ারের তালিকায় সবার পেশা জানিনা। তবে এই ভদ্রলোকের নামের সঙ্গে বাবুর্চি দেখে গর্ব হলো, ভাবলাম এমন গুণি মানুষও আছে আমার ফ্রেন্ড তালিকায় ! আমরা যদি ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, প্ল্যানার এসব নামের সঙ্গে লিখতে পারি উনি কেন পারবেন না? বরং গর্বের সঙ্গেই লেখা উচিৎ। উনি যতগুলো হাঁড়ি সামলাচ্ছেন, যে হাজার হাজার মানুষকে খাইয়ে খুশি করার দায়িত্ব নিয়েছেন তা দেশের কয়জন রথী-মহারথী পারবেন? সত্যি ভাই, আপনার জন্য ভালো লাগছে, আপনার ভিডিওটি দেখে আমার লোভ জাগছে, দেশে থাকলে নিশ্চিত কোন একদিন আপনার কোন রান্নার প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্য আপনার কাছ থেকে দাওয়াত চেয়ে নিতাম।
বাংলাদেশের একটা বড় সমস্যা মানুষ দিনের পর দিন বসে থাকে কিন্তু তার জন্য সহজলভ্য কাজটি করে না। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে সবাই বছরের পর বছর বেকার পড়ে থাকবে তবুও সহজে পাওয়া যায় বা করা যায় এমন কাজগুলোও করবে না। দেশের মিডিয়াগুলোও তেমন। সেখানে প্রায়ই সংবাদ দেখবেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চায়ের দোকানদার’ টাইপের। কি সমস্যা সেটায়? পরিশ্রম করে, সৎ উপায়ে যে কোন জীবিকা নির্বাহ করা সম্মানের। ঘুষ, দুর্নীতি, ভেজাল, দখল, কমিশন, লুটপাট এসব করে রাজা-বাদশাহ হওয়ার চেয়ে চায়ের দোকান দিয়ে সততার সঙ্গে জীবন কাটানো ঢের ভালো। এর মর্ম যতদিন মানুষ, সমাজ না বুঝবে ততোদিন এদেশের প্রকৃত উন্নয়ন হবে না।
জীবনের লক্ষ্য কী? বা বড় হয়ে কী হতে চাও? – ছোটবেলায় আমাদেরকে এই প্রশ্ন কেউ করলে মুহুর্ত বিলম্ব না করেই বলে ফেলতাম – ডাক্তার, নয়তো ইঞ্জিনিয়ার হবো। আমার দেখা হাতে গোনা খুব কম শিশুই ছিলো – যারা হয়ত বলতো- পাইলট, পুলিশ অফিসার বা শিক্ষক হতে চাই। সম্ভবত পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই একই অবস্থা। বড় হয়ে ডাক পিয়ন বা বাস চালক হতে চাই – আমাদের দেশের কোনো শিশুকে এমনটা বলতে শুনিনি। প্রতিদিন ভোরে জানালা খুললেই আমাদের চোখে পড়ে ময়লাওয়ালা, পোষ্টম্যান বা বাস চালক কি হাস্যোজ্জ্বল আর আন্তরিকতাসহ অক্লান্ত পরিশ্রম করে সবাইকে জরুরী সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এই পরিশ্রমী পেশাজীবীরা আসলেই সমাজের শিশু-নারী-পুরুষ-সবাইকে ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজে যাবার জন্য প্রেরণা যোগান। কাজ করে পরিশ্রমী, সৎ, সম্মানজনক আর স্বনির্ভর জীবন যাপনের উদাহরণ দেখান। আমাদের দেশটা টিকে আছে লক্ষ লক্ষ গার্মেন্টস কর্মীর সকালে উঠে একটা টিফিন ক্যারিয়ার হাতে নিয়ে লাইন ধরে ফ্যাক্টরীর উদ্দেশে দৌঁড়ানোর কারনে। সেটা বুঝবেন না, পারবেন শুধু ‘গার্মেন্টস এর মেয়ে’ বলে তাচ্ছিল্য করতে। পরিবারের শিশুরাও ছোট থেকে এভাবেই শিখে বড় হয়।
বেঁচে থাকার জন্য বাঙালির জীবনে ‘কাজ’ তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। বাঙালির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ‘সুখ’। মানে জীবনে ‘কাজ’ ছাড়াই ‘সুখ’; যে যতো বেশীদিন কাজ না করে বেঁচে থাকতে পারে, যে যতো কম কাজ করে রাজার হালে থাকতে পারে সে জীবনে ততো বেশি সুখী মানুষ। এটা বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। এজন্য কায়িক পরিশ্রম যেমন মাঠের কৃষিকাজ অনেকের কাছে খুব অপছন্দের একটি বিষয়, অন্যদিকে সরকারী অফিসের কেরানী হলেও ঘুষের টাকায় কাজ না করেও রাজার হালে চলাকে সমাজে খুব সম্মানের চোখে দেখা হয়।
ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোর জনগণের বেঁচে থাকার জন্য জীবনের প্রধান সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক উপকরণই হচ্ছে কাজ। তাদের প্রতিদিনের এবং পুরো জীবনের বেশির ভাগ সময়টাই কেটে যায় কাজ করে। তাই তাদের জীবন যাপনে, তাদের আচরণে, কথা-বার্তায়, পোশাকে-আশাকে, এমনকি চেহারায়ও সারাক্ষণ ফুটে ওঠে কাজের ছাপ, তাদের পেশার ছাপ। এই উন্নত আর পরিশ্রমী দেশগুলোর মানুষেরা কখনো বিদেশে শুধু থাকতে যায়না। তারা বিদেশে কাজ করতে যায়। যেমন, তারা বলে – আমি আমেরিকায় কাজ করি। আমার ভাই ইউরোপে কাজ করে কিংবা আমার স্ত্রী বা স্বামী জাপানে কাজ করেন। আর এক্ষেত্রে বাঙালির ভাষা হচ্ছে – আমি আমেরিকায় থাকি। আমার ভাই ইউরোপে থাকে কিংবা আমার স্বামী জাপানে থাকেন।
বিশ্বের সবচেয়ে সুখী জাতি হচ্ছে – ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান জাতিগুলো। আর তাদের সুখের প্রথম শর্ত হচ্ছে – তাদের কাজের প্রতি সন্তুষ্টি এবং তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যায়ের সামঞ্জস্য। আর দ্বিতীয়ত তাদের সামাজিক নিরাপত্তা। অন্যদিকে, বাঙালি নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী জাতি হিসেবে দাবী করে থাকে। কারণ, বাঙালির সুখের প্রথম শর্ত হচ্ছে – কাজ না করেই জীবনটা পার করে দিতে পারা। বাঙালি সুখী জাতি; কারণ বেশিরভাগ বাঙালিকে ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজে যেতে হয়না, তারা রাত জাগা উপভোগ করতে পারে। তারা রাত জেগে দেশি-বিদেশি খেলা দেখতে পারে, শিল্প-সাহিত্য চর্চা করতে পারে, সারাদিন আড্ডা দিতে পারে, বিশ্বকাপ খেলার সময় উন্মাদ হয়ে যেতে পারে, নির্বাচনের সময় দিন-রাত এক করে নেতার প্রচারে ব্যস্ত থাকতে পারে, রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং তাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বাঙালি সচেতন মানুষেরা সারারাত জেগে আর সারাদিন আড্ডা দিয়ে বিশ্বের রাজনীতি, অর্থনীতি আর দার্শনিক চিন্তা ভাবনা করতে পারে, কাজের কাজ করাটা তাদের রীতিতে নেই।
সবচেয়ে বেশি বেকারত্বের, ভয়াবহ দুর্নীতিগ্রস্ত আর সামাজিক নিরাপত্তাহীন একটা জাতি যে সবচেয়ে বেশি সুখী হতে পারে সেটা বাংলাদেশে না জন্মালে কেউ টের পেতো না। বাংলাদেশের এই বাবুর্চি, গার্মেন্টস এর কর্মী, মাঠের কৃষক, নির্মান শ্রমিক, সুইপার, ড্রাইভার, হেল্পারসহ যারা সরাসরি কাজের সঙ্গে জড়িত তারাই বাংলাদেশকে টিকিয়ে রেখেছে; অন্যদিকে অন্য যারা আছে তাদের এদের উপরেই নির্ভরশীল পরগাছা বা আগাছা বলতে পারেন। কিন্তু সেই নির্ভরশীলরা আবার দাবী করেন তারাই সবচেয়ে বেশী সম্মানের, অন্যরা চাষা-ভূষা, ক্ষ্যাত।
Baburchi Md Selim ভাই, একদিন আপনার কোন একটা প্রোগ্রামে আমাকে দাওয়াত দিয়েন, কিছু কাজ করে দিলাম আপনার সঙ্গে, বিনিময়ে আপনার হাতের জাদুর ছোঁয়ায় তৈরি কিছু সুস্বাদু খাবারের স্বাদ নিলাম।
Related Posts

১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন – বি এন পি যেভাবে গনতন্ত্র ধ্বংস করেছিল
২০২৪ এর ঐতিহাসিক গণ-অভভুত্থানের আগে ১৯৯০ সালে ছাত্র জনতার ত্যাগের বিনিময়ে দেশে গণতন্ত্র বিকাশের যেRead More

This Religious Frenzy Must End Now – Walk the Path of Civilization
Bangladesh’s society has changed dramatically over the past 20–30 years. One of the most destructiveRead More

স্বৈরাচার যখন দানব হয়ে যায় তখন মানুষের লাশের গন্ধ তাদের কাছে প্রিয় হয়
আমি আওয়ামী লীগের কোন পর্যায়ের কমিটির কখনোই কেউ ছিলাম না, এখনো নেই। আওয়ামী লীগ বাRead More
Comments are Closed