Viruses and Civilization
আপনি কি জানেন মানুষের বিকাশ ও সভ্যতায় ভাইরাসের অবদান অনেক ?
আমি আগেও লিখেছি এই পৃথিবী মূলত ভাইরাস, ব্যকটেরিয়াদের। আমরা তাদের সেই পৃথিবীতে পরজীবী। এই পৃথিবীতে মানুষ ও অন্য প্রাণীদের বেঁচে থাকার অনেক কিছুর জন্যই বড় অবদান আছে আমাদের ভাষায় এই সমস্ত পরজীবী জীবানুদের। একবার ভাবুন তো আজ যে মানুষ এত বুদ্ধির অধিকারী, এত এত উন্নতি করছে বিজ্ঞানে, সৃষ্টির সেরা বলে নিজেকে দাবী করছে – তার জন্য সবচেয়ে বড় অবদান কোন এক ভাইরাস প্রজাতির, মেনে নিবেন সেটা ? বিজ্ঞানীরা কিন্তু তেমনটাই মনে করেন। লক্ষ লক্ষ বছর আগে প্রাণীদের বিবর্তনের ধারায় মানুষ ও শিম্পাঞ্জির যে কমন এনসিস্টর ছিল সেটা তো জানেন। কিন্তু কি এমন হয়ে গেল যে শিম্পাঞ্জিরা এখনো সেই বুনো শিম্পাঞ্জিই রয়ে গেল আর মানুষ হয়ে উঠল পৃথিবীর অধীশ্বর ? এখানেই ভূমিকা রেখেছিল এক ভাইরাস প্রজাতি। ঘটনাটা আদৌ কোন পরিকল্পনামাফিক হয়নি, নেহায়েৎই এক দূর্ঘটনা। এই মহাবিশ্ব, এই পৃথিবী, এত এত জীব, এই আবহাওয়া কোন কিছুই পরিকল্পনামাফিক হয়নি, সবই নিছক কিছু দূর্ঘটনার ফল। আজ সেগুলো নিজেরাই একটা আপাত সিস্টেমে এসে থিথু হয়েছে সাময়িক সময়ের জন্য, আমরা ভাবি সবকিছু চলছে পরিকল্পনামাফিক।
বিজ্ঞানীদের মতে আজ যে বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মানুষ ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে নেমেছে মানুষের সেই বুদ্ধিমত্তাও মূলত এক প্রজাতির ভাইরাসেরই অবদান।
ভাইরাস কি মানুষের বন্ধু হতে পারে ? করোনা সংক্রামণে বিপর্যস্ত পৃথিবীতে এ মুহূর্তে এ প্রশ্নের উত্তর মোটেই ইতিবাচক হবে না। জগতের তাবৎ পরাশক্তিগুলো শক্তি হারিয়ে ভাইরাসের প্রচন্ড দাপটে থরকম্প। অনেকে এমনও ইঙ্গিত করেছেন যে এই অতিক্ষুদ্র দানবের তাণ্ডবে পুরো মানবসভ্যতা বিলীন হতে পারে।
এরপরও বিজ্ঞানীরা যেটা বলেন, তা ভাইরাস সম্পর্কে সাধারণের এমন নেতিবাচক ধারণার বিপরীত। পৃথিবীতে প্রায় ৫,০০০ প্রজাতির ভাইরাস আছে। এর মধ্যে মাত্র ২০০ প্রজাতি সত্যিকার অর্থে বিপজ্জনক। একদল ক্ষেপাটে বিজ্ঞানী আবার সুরক্ষা পোশাক পরে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, গহীন অরণ্য, দূর্গম গুয়া পাড়ি দিয়ে ভাইরাসের সন্ধানে বের হয় মানুষের জন্য ক্ষতিকর ভাইরাসের সন্ধান করতে, পৃথিবীকে সম্ভাব্য কোন মহামারি থেকে বাঁচাতে। তারা ভাইরাসের খনি বাদুড়ের দেহ থেকে ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করেন। সে অন্য প্রসঙ্গ। এখানে মূল প্রসঙ্গে থাকি। বন্ধু ভাইরাস, না ?
অণুজীববিজ্ঞানীরা যে ভাইরাসকে জীবিতদের দলে ফেলতে নারাজ, সেই ভাইরাস মানুষের বন্ধু নাকি শত্রু ? করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে আপাতদৃষ্টিতে ভাইরাসকে শত্রু মনে হলেও, কিছু ভাইরাস আমাদের পরম বন্ধু। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মানুষের হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের ইতিহাসে সেসব ভাইরাসের অবদান প্রচুর। তেমনি কয়েকটি ভাইরাসের গল্প আজ।
১. আর্ক জিন:
সুখের হোক বা দুঃখেরই হোক, আমাদের মস্তিষ্ক কী করে স্মৃতি সংরক্ষণ করে? আমরা যখন কিছু শিখি, আমরা তা কেমন করে মনে রাখি?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বহু বছর সমগ্র পৃথিবীর স্নায়ুবিজ্ঞানীরা গলদঘর্ম। অবশেষে এর উত্তরের জন্য তাদেরকে ফিরে যেতে হয়েছে জেনেটিক পরজীবী এই ভাইরাসের কাছে। মানুষের ইতিহাসের ঊষালগ্নে মানুষ যখন দু’পায়ে ভর করে হাঁটা শুরু করেছিল, তার বহু পূর্বে মানুষের পূর্ব পুরুষেরা এক বিশেষ ভাইরাস কর্তৃক সংক্রামিত হয়। এ সময়ে ভাইরাসের বংশগতির উপাদানের কয়েকটি আণবিক একক (জিন) মানুষের বংশগতির উপাদানের শৃঙ্খলে স্থান করে নেয়। আর এই কারণে মানুষের মস্তিস্ক এমন বিস্ময়কর গুণটির অধিকারী হয়। এক কথায় বলা চলে মানুষের আজকের বিস্ময়কর বুদ্ধিমত্তার মুলে ছিল এই ভাইরাস। অন্তত বিজ্ঞানীরা তাই মনে করেন। বিজ্ঞানীদের এই ধারনা যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে আজকের এই সভ্যতা, বিজ্ঞান, এত উন্নতি সব সম্ভব হয়েছে সেদিনের সেই ভাইরাসের সংক্রমনের ফলে।
২. প্রাচীন রেট্রোভাইরাস:
মানুষ কেন ডিম পাড়ে না? করোনা আক্রান্ত এ সময়ে ভাইরাসকে ধন্যবাদ দিলে তা হবে দুঃসময়ে দুঃসাহস। তারপরও ভাইরাস, বিশেষ করে প্রাচীন রেট্রোভাইরাসকে (Endogenous retrovirus ; ERVs) ধন্যবাদ। বংশ রক্ষায় ডিম পাড়া এবং তারপর তা দিয়ে বাচ্চা জন্ম দেয়ার মহাকষ্টকর প্রক্রিয়া থেকে মানুষকে রেহাই দিয়েছে এ ভাইরাস। শুনতে ভীষণই অদ্ভুত বা পাগলের প্রলাপ মনে হলেও বিজ্ঞানীরা এই মতবাদের সপক্ষে গবেষণালব্ধ তথ্য, উপাত্ত, প্রমাণ হাজির করে নামকরা জার্নালে নিবদ্ধ লিখেছেন। এসব নিবন্ধে বিজ্ঞানীরা যা বলতে চান তা খুব সহজ করে বললে যা হয় তা হলো, আদিম মানবদের পূর্বপুরুষের বংশগতির উপাদানে মিউটেশন (রূপান্তর) ঘটিয়ে গর্ভফুল বা প্লাসেন্টার খুবই জটিল বিবর্তনে এই ভাইরাসটির বিশেষ ভূমিকা ছিলো। আর সে কারণে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা ডিম পাড়ে না, সন্তান প্রসব করে। আর সেই স্তন্যপায়ীদের মধ্যে আছে মানুষও।
২০১৬ সালে বেশ নাম করা জার্নাল ‘সেল’ এ (The Cell) প্রকাশিত এক বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভাইরাস সংক্রামণের কারণে মানব জিনোমের ৪০ থেকে ৮০ শতাংশ এসেছে এ ভাইরাস থেকে।
৩. ব্যাকটেরিওফাজ :
এ ভাইরাসগুলি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে সংক্রামিত করে ধ্বংস করে। এগুলি প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যায়। মাটি, পানিতে এবং এমনকি মানবদেহে (বেশিরভাগ আমাদের অন্ত্রে এবং শ্লেষ্মায়) থাকে ব্যাকটেরিওফাজ। মানবদেহে ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করার জন্য এ ভাইরাসগুলিকে ব্যবহার করা হয়। অ্যান্টিবায়োটিক ভাল মন্দ ব্যাকটেরিয়া কাউকে রেহাই দেয় না। অন্যদিকে ব্যাকটেরিওফাজ খুঁজে খুঁজে শুধু মন্দ ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে। ইতিমধ্যে এর সুফল পাওয়া গেছে, বিশেষ করে ক্যান্সার নিরাময়ে এবং অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটিরিয়াকে নির্মূল করার জন্য এমন ভাইরাসের ব্যবহারে চিকিৎসা শাস্ত্রে এক নতুন আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে।
৪. ইন্ডিয়ানা ভেসিকুলোভাইরাস বা ভেসিকুলার স্টোমাটাইটিস ভাইরাস (VSV) :
এক ধরনের প্রোটিন ইন্টারফেরনের বাধার কারণে এ ভাইরাসটি মানব দেহের সুস্থ কোষকে ঘায়েল করতে পারে না। তবে যেসব ক্যান্সার কোষ যেখানে ইন্টারফেরন সাড়া দেয় না, এ ভাইরাসটি বেছে বেছে সেসব ক্যান্সার কোষগুলিকে ধ্বংস করে। গবেষকরা তাই ক্যান্সার নিরাময়ে এমন ভাইরাসকে ব্যবহারে উৎসাহী হন। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে এ ভাইরাসটি ব্যবহার করে টিউমারের আকার হ্রাস করা সম্ভব এবং এছাড়াও মেলানোমা, ফুসফুসের ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার, মস্তিষ্কের টিউমার চিকিৎসায় ভিএসভি ব্যবহার ইতিবাচক ফলাফল দিয়েছে। অধিকন্তু এইচআইভি (HIV) আক্রান্ত টি-সেলকে ধ্বংস করতে এই ভাইরাসকে পরিবর্তিত করে কাজে লাগানো হচ্ছে। এমন পরিবর্তিত ভাইরাসকে একটি সুন্দর নাম দেয়া হয়েছে— নামটি ‘ট্রয়ের ঘোড়া’।
রিকম্বিন্যান্ট ভি এস ভি ভাইরাসকে ইবোলার টিকা পরীক্ষায় চমৎকার ফলাফল পাওয়া গেছে। ইবোলা সংক্রমণ প্রতিরোধে উদ্ভাবিত টিকাটি ৭৬ শতাংশ থেকে শতভাগ কার্যকরী বলে জানা গেছে। মানব কল্যাণে এ ভাইরাসের আরো বহুবিধ ব্যবহারের সুযোগ আছে বলে গবেষকদের দৃঢ় বিশ্বাস।
৫. অ্যাডেনোভাইরাস :
অ্যাডেনোভাইরাসগুলি মোটামুটি সাধারণ ভাইরাসের একটি গ্রুপ। এগুলি অত্যন্ত সংক্রামক, সাধারণত কেবলমাত্র হালকা লক্ষণ দেখা দেয় এবং সাধারণত কয়েক দিনের মধ্যে চলে যায়। গবেষকরা জানিয়েছেন যে, এই ভাইরাসের একটি বিশেষ স্ট্রেন, এইচএডভি-৫২, ক্যান্সারের কোষগুলিতে উপস্থিত নির্দিষ্ট এক ধরণের শর্করাকে আবদ্ধ করে। আর তাই ক্যান্সার নিরাময়ের এই এইচএডভি-৫২ বেশ কার্যকরী হতে পারে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
৬. ভ্যাকসিন বা টিকা তৈরিতে ভাইরাস :
মানব এবং পশু পাখির দেহে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ভ্যাকসিন বা টিকার ভূমিকা আজ আর কারো অজানা নয়। এই টিকা প্রস্তুত করতে ভাইরাস ব্যবহার হয়। সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছে গোবসন্তের ভাইরাস। শতাব্দীর পর শতাব্দী পৃথিবীব্যাপী ত্রাসের নাম ছিল গুটিবসন্ত। শুধুমাত্র বিংশ শতাব্দীতেই গুটিবসন্তে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ। ভয়ংকর রোগটি আজ এক বিষণ্ন ইতিহাস। অথচ এই অতি ভয়ঙ্কর সংক্রামক ব্যাধির মহৌষধ লুকানো ছিল আরেকটি ভাইরাসে। আর তা হলো এই গোবসন্তের ভাইরাস।
চিকিৎসার পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রেও ভাইরাসের ব্যাপক ব্যবহারের পথ উম্মুক্ত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা নিরলস গবেষণা করে যাচ্ছেন ভাইরাসের গুপ্ত রহস্য উম্মোচনের জন্য। আর এমন গবেষণায় উঠে আসছে বিস্ময়কর সব তথ্য।
বিজ্ঞানীদের মতে মস্তিস্কহীন এই ভাইরাস বহু আগেই মানুষের মস্তিস্ক দখল করে নিয়েছে। আজ মানুষেরা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে বুদ্ধিভিত্তিক লড়াই করছে পক্ষান্তরে তা কিন্তু ভাইরাসের অবদান। তাই ভাইরাস বন্ধু না শত্রু এ প্রশ্নের উত্তর দিতে কারো বেগ পাবার কথা নয়, কারণ অতি-আণুবীক্ষণিক এবং অকোষীয় এই ভাইরাস আমাদেরকে সে বুদ্ধিমত্তা দিয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১. Neuroscience & Biobehavioral Reviews, ২০১৯ এপ্রিল ৯৯:২৭৫-২৮১।
২. এডওয়ার্ড বি চুং, POLS Biology, ২০১৮ অক্টোবর ই ৩০০০০২৮ অথবা আবির মিত্র, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, ৩১ জানুয়ারি ২০২০।
৩. JOURNAL OF GENERAL VIROLOGY, ২০১২ ডিসেম্বর ৯৩ (পিটি ১২): ২৫২৯–২৫৪৫।
[ কৃতজ্ঞতাঃ মইনুল হাসান, অণুজীববিজ্ঞানী এবং ফরাসি বিচার বিভাগে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত। https://tinyurl.com/ybhdl28o ]
Related Posts
What can be the problem if someone takes blood from his family member?
This is a frequently asked and very important question about blood donation. If you wantRead More
কেউ তার পরিবারের সদস্য থেকে রক্ত নিলে কি সমস্যা হতে পারে?
ব্লাড ডোনেশন সম্পর্কে এটা বহুল জিজ্ঞাসিত ও অত্যন্ত গুরত্বপূর্ন একটা প্রশ্ন। ছোট করে উত্তর শুনতেRead More
ফেবু মুমিনদের সহজ সরলতা, কুযুক্তি ও শেষে চাপাতির কোপ !
ফেসবুকীয় মুমিন মানেই ‘ছাগল” অন্যকথায় ছাগু (ফেসবুক আবার তাদের সম্মানার্থে ছাগু সরাসরি লিখলে গোস্বা করেRead More
Comments are Closed