Racism
Religion and Racism

Religion and Racism: One Evidence

মানুষের উচ্চতা না মেপে তার মৃত্যুতে খুশি হওয়ার ছেলে-মেয়েও এখন অজস্র

খুব ছোটবেলার কথা। আমাদের এলাকায় এক দরবেশ আসছিলেন, বাগেরহাটের মানুষ। অনেক সহায় সম্পদের মালিক, তার ভাষায়। আস্তানা গাড়লেন আমাদের এলাকার এক বাড়িতে। খালি পায়ে হাঁটেন, এটাই নাকি নিয়ম। আমাদের ৩ টা পুকুর ছিল, তার একটা লিজ নিয়ে মাছ চাষ শুরু করলেন, চারিদিকে অবিবাহিত, সন্তানহীনদের চিকিৎসা করা শুরু করলেন। এই প্রসঙ্গের একটু পরে আরো বলছি।

পাশের হিন্দু ঘোষ পাড়ায় একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ধর্মহীন, বিজ্ঞানমনস্ক। উনি আমদের বাড়িতে আসতেন প্রায় প্রতিদিন। আমাদের বাড়িতে বই এর আধিক্য ছিল, আমার আব্বাও এক সময় হাইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। গ্রামে বাড়ি হলেও সকালের পত্রিকা সন্ধ্যায় আসতো আমাদের বাড়িতে। যাইহোক, সেই হিন্দু সম্প্রদায়ের বয়স্ক ভদ্রলোক ধর্মের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরতেন। আমার আব্বা নামাজ রোজা ঠিকমতো না করলেও কঠিনভাবে ধর্ম বিশ্বাসী। তবুও একজন ভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মহীন জ্ঞানি মানুষের সঙ্গে আমাদের সহাবস্থান ছিল শ্রদ্ধার। অন্য অনেক মাদ্রাসা পড়ুয়া আলেমরাও সেই ভদ্রলোককে শ্রদ্ধা করতেন।

আমাদের এলাকার অনেক চাচাদের দেখেছি হিন্দু পাড়ায় গিয়ে সকাল বিকাল পড়ে থাকতে, আড্ডা দিতে, খেলা করতে। আমরাও গিয়েছি তাদের বিয়ের দাওয়াতে। পূজার সময় তাদের পূজামন্ডপের সামনের ছোট মেলায় যাওয়া আমাদের জন্য ছিল আনন্দের ব্যাপার। আমাদের এলাকার অনেক মা, চাচীকে দেখেছি আরতি দেখতে যেতে সন্ধ্যা রাতে। আমাদের পাড়ার অনেক বিয়েতে মাইক বাজিয়ে গান হতে দেখেছি কতো। গায়ে হলুদ এসব না থাকলেও সবার রঙ মাখামাখিতে থাকতো ভরপুর। বসন্তের শেষে সন্যাসী না আসলে মহিলারা আম খেতো না, এসব কুসংস্কারও মেনে চলতো। পাশের গ্রামের বৈশাখী মেলাকে কেউ আলাদা করে দেখতো না।

ঠিক সেই মানুষগুলোই এখন ছোট ছেলে-মেয়েদের আর পূজায় যেতে দেন না। পূজার মেলা মানেই সেটা নিষিদ্ধ। অনেক কিছুই এখন তাদের কাছে হিন্দুয়ানি মনে হয়, এমনকি গায়ে হলুদ, জন্মদিনও। শাওন, শ্রাবন, জুঁই, বেলী, হাসনা হেনা, টগর, অনন্ত, বকুল এই সমস্ত বাংলা নামের বদলে এখন বাঙালির নাম হয় কানেতা, লাম লাম প্রভৃতি। বৈশাখী মেলাকেও এখন হিন্দুয়ানি ট্যাগ দিয়ে বাচ্চাদের সেখানে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়।

এবার আবার সেই প্রথম প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ঐ যে নিধার্মিক ভদ্রলোক তিনি কিন্তু সবাইকে সতর্ক করেছিলেন এই দরবেশ কে নিয়ে। তার সেই যে পুকুর লিজ নেয়া, ব্যবসা সব কিন্তু গরীব আশ্রয়দাতার টাকা, উনি শুধু আশ্বাস দিয়েই গেছেন, স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন। একদিন কনকনে শীতের দিনে দেখা গেলো হুজুর তার চিরাচরিত খালি পায়ে হাঁটার বদলে জুতা পায়ে। আমার আব্বা জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন সেই বেশ ! একদিন শুনলাম পাশের গ্রামের এক লোভী পরিবার কে উঠান থেকে তিনটি টাকার জালা ( আমাদের এলাকায় প্রচলিত বড় মাটির পাত্র, কলসের চেয়ে অনেক বড় ) এনে দিবে বলে গোপনে অনেক টাকা হাতিয়ে রাতের আঁধারে পগারপার দরবেশ।

ধর্ম ব্যবসায়ী ভন্ড সব যুগেই ছিল তবে এখনকার মতো এতো উগ্র ছিল না। এখন কোন ধর্ম ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কেউ কথাই বলতে পারে না। সবার কাছে অজস্র ত্যানা, সেটা প্যাঁচিয়ে আপনার কন্ঠরোধ করতে চাইবেই, কারন আপনি কথা বললে তাদের হেলিকপ্টারে চড়া, উচ্চ দামে সময় কেনার ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সেই সময়ে কিন্তু এই কূটচাল ছিল না। একজন ভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের নিধার্মিক ব্যক্তিও ধর্ম ব্যবসায়ীর সমালোচনা করতে পারতেন।‍‍ সাধারন মানুষ কেউ তাকে বিশ্বাস করুক বা না করুক অসম্মান করতো না। আর এখন ? বাড়ি ঘেরাও, ভাংচুর, অসম্মান, অপদস্থ, জীবন নাশের হুমকি সবই থাকতো।

এই যে একটা উগ্র প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে এদের বয়স কতো ? ফেসবুকে কারো মতের বিপক্ষে কোন কথা বললেই যারা গালি দিয়ে ভরে ফেলে, উগ্র আচরন করে তাদের বয়স কতো ? ১৫ থেকে ২৫ হবে বড়জোর। এরা সহনশীলতা বাদ দিয়ে উগ্রতার পিছনে ছুঁটছে কেন ? আমরা যারা ৯০ এর দশকে বা একটু আগে শৈশব কৈশোর পার করেছি তারাই মনে হয় সর্বশেষ প্রজন্ম যারা পাড়া-মহল্লা, গ্রামে স্পোর্টস ক্লাব, কালচারাল প্রোগ্রাম, স্কুলে বিতর্ক প্রতিযোগীতা, হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা এসব দেখেছি। এর পরে সবাই খেলার মাঠ থেকে ঢুকেছে কম্পিউটার গেমে, পাড়ার ক্লাবের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা থেকে ঢুকেছে ফেসবুকে, থিয়েটার থেকে ঢুকেছে ইউটিউবে। ঐসব জনসম্পৃক্ত উদ্যোগের আলাদা একটা মর্ম ছিল যা এখনকার প্রজন্ম বুঝবে না।

আমি হাইস্কুলে পড়ার সময় গোলাম মোস্তফার লেখা ‘বিশ্বনবী’ কয়েকবার পড়ে শেষ করেছি। ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে স্কুলে প্রতিবছর মিলাদ ও রচনা প্রতিযোগীতা হতো। প্রতিবছর আমি প্রথম পুরষ্কারটা পেতাম সেখানে। ইসলামিক ফাউন্ডেশানের প্রতিযোগীতায় একবার উপজেলা পর্যায় থেকে বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের স্কুলের ৩ জন সেরা হয়। আমি, আমার অন্য এক ক্লাসমেট ও আমাদের জুনিয়র ক্লাস এইটে পড়া এক হিন্দু ছেলে। বিশ্বাস হচ্ছে তো ? ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিযোগীতায় এক হিন্দু ছেলে অংশগ্রহন করে উপজেলায় সেরা হয়ে জেলা পর্যায়ে যায় প্রতিযোগীতা করতে। এখন হলে সে অংশ নিতেই পারতো না এবং তার সহপাঠীরাই তাকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে কোনঠাসা করে দিতো। কারন এখনকার প্রজন্ম সেই সহনশীলতা দেখাতে পারে না। তারা মানুষের কাজ, মানুষের মেধা, মানুষের যোগ্যতার মূল্যায়ন, আলোচনা, সমালোচনা করতে পারেনা। বরং তারা বেশী উৎসাহী মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, ভিন্নমতের কারনে তাকে ব্যক্তি আক্রমন করতে, তার অমঙ্গল কামনা করতে। মানুষের উচ্চতা না মেপে তার মৃত্যুতে খুশি হওয়ার ছেলে-মেয়েও এখন অজস্র।

Related Posts

15 February 1996 Election

১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন – বি এন পি যেভাবে গনতন্ত্র ধ্বংস করেছিল

২০২৪ এর ঐতিহাসিক গণ-অভভুত্থানের আগে ১৯৯০ সালে ছাত্র জনতার ত্যাগের বিনিময়ে দেশে গণতন্ত্র বিকাশের যেRead More

This Religious Frenzy Must End Now – Walk the Path of Civilization

Bangladesh’s society has changed dramatically over the past 20–30 years. One of the most destructiveRead More

Fascist Sheikh Hasina

স্বৈরাচার যখন দানব হয়ে যায় তখন মানুষের লাশের গন্ধ তাদের কাছে প্রিয় হয়

আমি আওয়ামী লীগের কোন পর্যায়ের কমিটির কখনোই কেউ ছিলাম না, এখনো নেই। আওয়ামী লীগ বাRead More

Comments are Closed