
Homosexuality and Bangladesh
বাংলাদেশে সমপ্রেমীদের অধিকার নিয়ে কথা বলা কেন নিরাপদ নয়
বাংলাদেশে সমপ্রেম বা LGBTQ+ (Lesbian, Gay, Bisexual, Transgender, Queer) অধিকার নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা এখনো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যদিও সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, বাস্তবতা হলো – যে কেউ যদি সমপ্রেম, যৌন পরিচয় বা লিঙ্গ বৈচিত্র্য নিয়ে কথা বলেন, তাকে সামাজিক, ধর্মীয় এবং কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হয়।
আইনি বাধা
বাংলাদেশে এখনো দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা কার্যকর রয়েছে, যেখানে “প্রকৃতির বিরুদ্ধে যৌন সম্পর্ক” শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এই ধারাটি মূলত সমপ্রেমীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয় এবং এটি একটি বৈষম্যমূলক আইন। ফলে যারা LGBTQ+ অধিকার নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে চান, তারা আইনি ঝুঁকির পাশাপাশি সামাজিক প্রতিক্রিয়ার ভয়েও থাকেন।
সমলিঙ্গ আচরণ দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার অধীনে (১৮৬০ সালের আইন XLV) অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, যার শাস্তি দশ বছর থেকে শুরু করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। যৌনতার ভিত্তিতে বৈষম্যের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত সুরক্ষা নেই, এবং দেশে LGBTQ+ সংগঠনগুলো পরিচালনায় নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। LGBTQ+ ব্যক্তি ও অধিকারকর্মীরা সহিংসতার হুমকি বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন। [ লিংক ০১, লিংক ০২ ]
বাংলাদেশে সামাজিক ট্যাবু এবং বিবাহ ও সন্তান গ্রহণসহ প্রথাগত হেটারোসেক্সুয়াল, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মানদণ্ডে চলার চাপের কারণে অধিকাংশ LGBTQ+ ব্যক্তি তাদের যৌন পরিচয় গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে তারা বৈষম্য, সামাজিক বর্জন এবং পরিবার ও বিস্তৃত সমাজ থেকে শত্রুতার সম্মুখীন না হন। আন্তর্জাতিক রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ধর্মীয়তা এবং পারিবারিক সম্মানের সংযোগ অনেক অংশগ্রহণকারীকে [তাদের ফোকাস গ্রুপে] পরিবারের সঙ্গে একটি দুর্বল সমঝোতায় বাধ্য করেছে, যাতে তারা জনসমক্ষে তাদের যৌন বা লিঙ্গ পরিচয় গোপন রাখেন।” [ লিংক ]
রূপান্তর পদ্ধতি – যা ব্যক্তিগতভাবে, পরিবারের সদস্য, চিকিৎসা পেশাজীবী, ধর্মীয় ও সম্প্রদায়ের নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হয় – ব্যাপকভাবে প্রচলিত। [ লিংক ০১, লিংক ০২ ]
ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশে ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সামাজিক রক্ষণশীলতা সমপ্রেমের বিরুদ্ধে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। ইসলাম ধর্মে সমপ্রেমকে নিষিদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এবং অনেক ধর্মীয় নেতা প্রকাশ্যে LGBTQ+ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ান। ২০১৬ সালে LGBTQ+ অধিকার নিয়ে কাজ করা দুইজন অ্যাক্টিভিস্ট – জুলহাজ মান্নান এবং মাহবুব তনয়- ঢাকায় তাদের নিজ বাসায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড ছিল একটি ভয়াবহ বার্তা – বাংলাদেশে সমপ্রেম নিয়ে কথা বলার পরিণতি কতটা ভয়ংকর হতে পারে।
ইসলামে সমপ্রেম বা LGBTQ+ সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে সাধারণভাবে নিষিদ্ধ ও গুনাহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইসলামী ধর্মগ্রন্থ কোরআনে লুত (Lot) জাতির কাহিনি উল্লেখ করে পুরুষ-পুরুষ যৌন সম্পর্ককে “অপ্রাকৃতিক” ও “অবৈধ” বলা হয়েছে। সূরা আরাফ, সূরা হুদ, সূরা আনকাবুতসহ বিভিন্ন আয়াতে লুত জাতির সমপ্রেমমূলক আচরণের কারণে তাদের উপর আল্লাহর গজব নেমে আসে বলে বর্ণনা রয়েছে। হাদিসেও পুরুষদের মধ্যে যৌন সম্পর্ককে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে শাস্তির কথা বলা হয়েছে, হত্যার কথা বলা হয়েছে । ইসলামী আইন বা শরিয়াহ অনুযায়ী, সমপ্রেমকে “হারাম” বা নিষিদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং অনেক মুসলিম দেশ এই ভিত্তিতে LGBTQ+ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করেছে। ইসলামী শরিয়াহ-ভিত্তিক কিছু দেশে (যেমন: সৌদি আরব, ইরান) সমপ্রেমের জন্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
তবে আধুনিক ইসলামি চিন্তাবিদদের মধ্যে কিছু বিতর্ক রয়েছে – কিছুজন মানবাধিকারের আলোকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানালেও, মূলধারার ধর্মীয় ব্যাখ্যা এখনো কঠোরভাবে সমপ্রেমের বিরোধী। ফলে ইসলামী সমাজে LGBTQ+ বিষয়টি গভীরভাবে সংবেদনশীল এবং ধর্মীয়ভাবে বিতর্কিত। বাংলাদেশের সমাজেও এটিকে গর্হিত অন্যায় হিসাবে দেখা হয়, প্রায়ই ইসলামী বক্তারা সমপ্রেমীদের হত্যা করার কথা বলে থাকেন। রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কোনভাবে সমপ্রেমীদের অধিকার নিয়ে কথা বললে তার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে কমে যায়, তার বিরুদ্ধে মিছিল হয়।
অনলাইন হুমকি ও মিডিয়া
যারা অনলাইনে LGBTQ+ অধিকার নিয়ে লেখালেখি করেন, তারা প্রায়ই ট্রল, হুমকি এবং ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হন। অনেক সময় তাদের ছবি ও তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে “শাস্তি” দাবি করা হয়। এজন্য অধিকারকর্মীদের নানাভাবে নাজেহাল হতে হয়, আক্রমনের শিকার হতে হয়। একজন ব্লগার, যিনি “রেইনবো ঢাকা” নামে লেখালেখি করতেন, পরিচয় ফাঁস হওয়ার পর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হন এবং পরে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। তিনি লিখেছিলেন, “আমি শুধু ভালোবাসার স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেছিলাম, কিন্তু আমাকে যেন রাষ্ট্রদ্রোহী বানিয়ে দেওয়া হলো।”
রাষ্ট্রীয় নীরবতা
বাংলাদেশ সরকার LGBTQ+ অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নের মুখে পড়লেও অভ্যন্তরীণভাবে কোনো ইতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেনি। বরং অনেক সময় সরকারি কর্মকর্তারা LGBTQ+ বিষয়কে “অসামাজিক কার্যকলাপ” হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ২০১৪ সালে জাতিসংঘের Universal Periodic Review-এ বাংলাদেশকে LGBTQ+ অধিকার রক্ষার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়, কিন্তু সরকার তা “সংবিধান ও ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিপন্থী” বলে প্রত্যাখ্যান করে। রাষ্ট্র ও সমাজ সমপ্রেমকে এখনো মানুষের বিকৃত রুচি বলে গণ্য করে।
শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব
বাংলাদেশের পাঠ্যবই, গণমাধ্যম এবং সামাজিক আলোচনায় LGBTQ+ বিষয় প্রায় অনুপস্থিত। ফলে সাধারণ মানুষ এই বিষয়ে জানেন না, এবং অজ্ঞানতাজনিত ভয় ও ঘৃণা তৈরি হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৫% তরুণ LGBTQ+ শব্দের অর্থ জানেন না, এবং ৮৫% মনে করেন এটি “অসুস্থতা” বা “পাপ”। এই ভুল ধারণা সমাজে ঘৃণার সংস্কৃতি তৈরি করে, যা LGBTQ+ ব্যক্তিদের জীবনকে আরও অনিরাপদ করে তোলে।
আন্তর্জাতিক তুলনা
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালে ৩৭৭ ধারা বাতিল করে সমপ্রেমকে বৈধতা দেয়। নেপাল, ভুটান এবং শ্রীলঙ্কাও LGBTQ+ অধিকার নিয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো সেই পথে হাঁটেনি। এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশে LGBTQ+ ব্যক্তিরা আইনি সুরক্ষা, সামাজিক স্বীকৃতি এবং স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন, যেখানে বাংলাদেশে তারা এখনো “অদৃশ্য” নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। কারো পরিচয় প্রকাশ পেলে তাকে সামাজিকভাবে একঘরে করে দেয়া হয়, তার জীবনও হুমকির মুখে পড়ে যায়।
আশার আলো
তবে কিছু সাহসী ব্যক্তি, সংগঠন এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্ম LGBTQ+ অধিকার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। “রূপবান”, “বয়েজ অফ বাংলাদেশ”, “মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন” ইত্যাদি সংগঠন সচেতনতা বাড়াতে চেষ্টা করছে। অনেক তরুণ এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় সমপ্রেম নিয়ে কথা বলছেন, যদিও তারা ছদ্মনামে বা গোপনে তা করছেন। এই সাহসিকতা ভবিষ্যতের জন্য একটি আশার বার্তা।
উপসংহার
বাংলাদেশে সমপ্রেমীদের অধিকার নিয়ে কথা বলা এখনো নিরাপদ নয়, কারণ আইনি কাঠামো, ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক রক্ষণশীলতা এবং রাষ্ট্রীয় নীরবতা এই বিষয়টিকে “বিপজ্জনক” করে তুলেছে। যারা এই বিষয়ে কথা বলেন, তারা শুধু মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছেন না, তারা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন। একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক এবং আধুনিক সমাজ গড়তে হলে LGBTQ+ অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। ভালোবাসা, পরিচয় এবং স্বাধীনতা- এই তিনটি বিষয় কোনো অপরাধ নয়। বরং এগুলো মানবাধিকারের মৌলিক স্তম্ভ। বাংলাদেশে এই পরিবর্তন আনতে হলে দরকার শিক্ষা, সচেতনতা, আইনি সংস্কার এবং সামাজিক সহনশীলতা। যতদিন না এই বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হয়, ততদিন সমপ্রেমীদের অধিকার নিয়ে কথা বলা নিরাপদ না।
Related Posts

How much longer will the Muslim extremists in Bangladesh continue to oppress Hindus?
Ever since I became aware of the world around me in Bangladesh, I’ve witnessed violenceRead More

বাংলাদেশের মুসলিম উগ্রবাদীরা হিন্দুদের উপর আর কতো অত্যাচার চালাবে?
বুদ্ধি জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি, ইসলাম ধর্ম বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের নবীকে অবমাননারRead More

The Uncertain Lives of Freethinkers in Bangladesh: Fundamentalist Persecution of Atheist and Secular Bloggers
Over the past decade, freedom of expression in Bangladesh has been severely restricted, especially forRead More
Comments are Closed