Hero Alom
Hero Alom

A Hero Alom !

হিরো আলমঃ এক উনমানবের স্বপ্ন পূরনের শক্তি সবার জন্য অনুপ্রেরনা হতে পারে

সেবার যখন সাউথ এশিয়ায় বলিউডের শীর্ষ নায়ক সালমান খানের নাম পিছনে ফেলে নেটিজেনরা হিরো আলমের নাম সার্চ করে দেখছিলেন, হিরো আলম যখন গুগল সার্চ লিস্টে সবার উপরে চলে আসে তখন মূলধারার গণমাধ্যম, মিডিয়া সবাই বেশ নড়েচড়ে বসে। বলছি ২০১৭ সালের কথা। হিরো আলম নামক একজন মানুষকে উপরে উঠার সিঁড়ির কিছুটা অংশ হতে পেরেছিলাম আমি। সত্যি জিরো থেকে হিরো হয়ে উঠা এক অদম্য মানবের গল্প সেটা, জীবনের না পাওয়ার কষ্টগুলোকে স্বপ্নে পরিনত করে তা বাস্তবায়ন করতে চাওয়া এক দুঃসাহসী মানবের সেই কাহিনীটি সত্যি বিষ্ময় জাগানিয়া। মানুষ চাইলে কি না পারে।

‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’ – কথাটি বলেছিলেন শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার জয়ী গ্রামীন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস। হিরো আলম সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছেন। অজপাড়াগাঁয়ের এক অনাথ শিশু আশরাফুল হোসেন আলম দারিদ্রের সঙ্গে বড় হয়েছে। বুদ্ধি জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই অন্যের বাড়িতে কামলা খেটে তার দিন চলতো। বাংলাদেশের সামাজিক পরিমন্ডলে সে ছিলো খুবই অবহেলিত, অনাদরে বেড়ে উঠা এক পথশিশু। সামাজিক সম্মান ও অধিকার বলতে কিছুই তার ছিলো না। একটু বড় হলে সে টুকটাক ছোটখাটো ব্যাবসা শুরু করে। পথে পথে বাদাম, মুড়ি, চানাচুর, সিগারেট বিক্রি করা শুরু করলো। এরপর একদিন সে একটি দোকান দিয়ে বসলো, মানুষের বাড়িতে স্যাটালাইট টিভি কানেকশান বা ডিশ লাগানর ব্যাবসা। দিনে দিনে ব্যবসা বাড়িয়ে সেখানে সে সিডি ভাড়া দিতে শুরু করলো। হিন্দি ও বাংলা সিনেমার সিডি মানুষকে ভাড়া দিতো। তার নিজের মনেও সুপ্ত বাসনা ছিলো সেও সিনেমার নায়ক হবে। সে নিজে মিউজিক ভিডিওর মডেল হয়ে ভিডিও ধারন করতে শুরু করলো। নিজের ক্যাবল নেটওয়ার্কে সেগুলো সম্প্রচারও করতো। মানুষ হাসির বিষয় হিসাবে সেগুলো দেখতো। একদিন ইউটিউবে আপলোড করা শুরু করলো নিজের ভিডিও। একদিন দুইদিন করে ভাইরাল হয়ে গেলো। একসময় সমগ্র দক্ষিন এশিয়াজুড়ে তার নাম সবাই জেনে গেলো। যাইহোক, সে তার সপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগিয়েছে। সমাজের অনধিকারগুলোকে, অসম্মানগুলোকে, অবহেলাগুলোকে সে অতিক্রম করতে চেয়েছে এবং দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নিজেই নিজের নাম বেছে নিয়েছে হিরো আলম, এই নামেই এখন সবাই তাকে চেনে।

ইচ্ছা পূরনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কোন বাঁধা হতে পারে না। হিরো আলম খুব বেশীদূর যেতে পারেনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়। শিশু বয়স থেকেই শ্রম দেয়া শুরু করায় প্রাথমিক স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেনী পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো, তাও যেনোতেনোভাবে। কিন্তু সে নিজে একটি বই লিখেছে, এখন যা অনেকের জন্য অনুপ্রেরনার। সেই বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে জীবন বদলে যায়। মানুষ ভেদাভেদ কেন তৈরি করে ? কারন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অশিক্ষিত হিরো আলমের কথা এখন বিভিন্ন মঞ্চে শোনা হয় কারন সেগুলো অনেকের জন্য অনুপ্রেরনার কারন হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তিনি বলে থাকেন তিনি যদি তার সুবিধাবঞ্চিত অবস্থা থেকে বর্তমানের এই পর্যায়ে আসতে পারেন তবে অন্যরা এতো সুবিধা পেয়েও কেন তাদের জীবনকে পরিবর্তন করতে পারবে না ? মানুষ চাইলে সবই পারে, শুধু দরকার ইচ্ছাশক্তি, তা বাস্তবায়নের সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম। হিরো আলম মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছেন স্কুলের বারান্দায় পা না দিয়েও মানুষ তার ইচ্ছাকে বাস্তবে রুপ দিতে পারে।

সিনেমার নায়ক হওয়ার জন্য চেহারা কোন বাঁধা নয়। হিরো আলম দাবী করেন তিনি তথাকথিত মানুষের দৃষ্টিতে সুন্দর নন, কুৎসিত। তবে তিনি তার এই চেহারা নিয়ে কয়েকটি বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেছেন, অসংখ্য শর্ট ফিল্মে অভিনয় করেছেন। বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রীর অনেকে তাকে অপমানিত, অপদস্থ করেছেন। তাকে অসংখ্যবার শুনতে হয়েছে এই কদাকার চেহারা নিয়ে কেন সিনেমার নায়ক হতে এসেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তার জনপ্রিয়তা এখন অন্য অনেকের চেয়ে বেশী। বাংলাদেশ, ভারতের স্টেজ শোগুলোতে তার আবির্ভাব সেই প্রমান দেয়। তিনি এতোই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে তার সিডিউল পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে উঠেছে অনেক আয়োজকের জন্য। তিনি অভিনয় কেমন পারেন বা অভিনয় দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট কতটা করতে পারেন তার চেয়ে এখন বড় হয়ে উঠেছে তার জনপ্রিয়তার পরিমাপ। বাংলা সিনেমার গন্ডি ছাড়িয়ে এখন তার ডাক পড়তে শুরু করেছে হিন্দি সিনেমা থেকেও।

‘দৃষ্টিভংগি বদলান, আমরা সমাজকে বদলে দিবো’ – এটি হিরো আলমের লেখা বইয়ের নাম। তাকে নিয়ে ভারত বাংলাদেশে হয়েছে অসংখ্য ট্রল। তাকে তুচ্ছ, তাচ্ছিল্য করে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য ইউটিউব ভিডিও। কিন্তু তার নিজের সংগ্রাম ও সাফল্যের পাল্লা মাপলে সবার তাচ্ছিল্য ম্লান হয়ে যাবে। তিনি বলেন তার জীবনটা কতটুকু কষ্টের মধ্যে পার হয়েছে এবং কতটুকু পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি হিরো আলম হয়েছেন সেটা শুধু তিনিই জানেন। সবাই তার পর্দার পেছনের ঘটনাগুলো জানলে আজ হয়তো মানুষ তাকে নিয়ে ট্রল করতো না, বরং তাকে আরো উৎসাহ দিতো। যাই হোক, এখনো সময় আছে,  মানুষ যদি দৃষ্টিভঙ্গি না বদলায় তাহলে আমাদের সমাজ এবং দেশ কখনোই বদলাবে না। তিনি বলেন তিনি তার ভক্তদের একবার ধন্যবাদ দিলে তার সমালোচকদের দুইবার ধন্যবাদ দেন। কোন সমালোচনা, নেতিবাচক প্রচারনা তার স্বপ্ন পূরনের গতিকে বাঁধা দিতে পারেনি। হিরো আলম এর মধ্যে আবেগ আছে, ভালোবাসা আছে, মানবতাও আছে। তিনি সাধারণের বেশে চলাফেরা করেন। তিনি নিজেকে একজন হিরো হিসেবে দাবি করেন। তিনি হার মানতে চান না, তাই মানুষ তার প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীলও।

সমাজের হিরোরা সিনেমার হিরোদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সমাজের হিরো হতে সবাই পারে না। পর্দার চরিত্রের প্রতিবাদী নায়ককে দর্শক বাস্তব জীবনেও ন্যায় ও সত্যের পক্ষে প্রতিবাদী চরিত্রেই দেখতে চান। কিন্তু তা কি দেখা যায় ? পর্দার সবাই বাস্তবে সামাজিক হিরো হতে পারেন না। কিন্তু হিরো আলম অনেক নিপীড়িতের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, দূর্যোগ দূর্বিপাকে মানুষকে সহযোগীতা করেছেন, মানুষের রাজনৈতিক ও বাক স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছেন। এজন্য তিনি সাম্প্রদায়িক শক্তি ও অগনতান্ত্রিক সরকারের নিপীড়নের শিকারও হয়েছেন। কয়জন নায়ক এমনটা বাস্তব জীবনে করেন ? হিরো শব্দটি ইংরেজি । এর অর্থ নায়ক আর বড় অর্থে বললে কোন একটি গুণাবলীর ঊর্ধে উঠে যাওয়া মানুষকে বুঝায় । এই হিরো যে সেলুলার পর্দাতেই হতে হবে কিংবা ফ্যান্টাসি জগতেই হতে হবে তাই নয়, বাস্তব জগতেও হিরোরা বাস করে । সত্যিকার অর্থে আশরাফুল আলমরাই হিরো । কারণ তিনি হয়তো লৌকিকতার সাথে মানানসই নয় কিন্তু নির্বাচনে দাড়িয়ে নিজে বুক ঠেকিয়ে প্রতিবাদ হোক কিংবা নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গণধর্ষণ এর শিকার গৃহবধূকে দেখতে যেয়ে সরাসরি আসামীদের ধরতে বলার আল্টিমেটাম দেওয়া কিংবা আরও অনেক কারণই আসলে তাকে হিরোর আসনে বসিয়েছে। হিরোরা যে শুধুই চেহারা দিয়েই হিরো হয় না, এই আশরাফুল আলম তার একটি জলজ্যান্ত প্রমাণ। নিজের জীবনের না পাওয়ার কষ্ট, অধিকারহীনতা তাকে অন্যদের অধিকার রক্ষায় বলিষ্ট করেছে।

একথা সত্যি যে হিরো আলমের যে কাজ, তা মানের প্রশ্নে এত আলোচনার দাবি রাখে না। আলোচিত হওয়ার মত উল্লেখযোগ্য কাজ তিনি করেননি। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, তাকে নিয়ে আলোচনাইবা কেন? কারণ হিরো আলম বাংলাদেশের একজন প্রান্তিক মানুষ, স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকারের জন্য তিনি সংগ্রাম করেছেন, তার আছে ইচ্ছাশক্তি পূরনের এক অদম্য সাহস। এজন্য তাকে অবহেলা করেন অনেকে কিন্তু তাকে আলোচনায় রাখতে হয় মানুষকে কারন হিরো আলমকে ছোট করতে গেলে, তার কাছে নিজেরা ছোট হয়ে যেতে হয়। দিনশেষে তিনি সেইসব মানুষের জন্য অনুপ্রেরনার শক্তি হয়ে উঠতে পারেন যারা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের সব সুবিধা পেয়েও হতাশার সাগরে ভেসে ব্যর্থ হয়ে যান।

Related Posts

No Profession is Small

Do not belittle anyone’s profession – ensure their rights instead

Look at the narrative pushed by the so-called elite Bangu media and society! This isRead More

No Profession is Small

কারো পেশাকে ছোট করবেন না, বরং তার অধিকার নিশ্চিত করুন

বাঙ্গু সুশীল মিডিয়া ও সমাজের ন্যারেটিভ দেখেন! এটা বাংলাদেশের মানুষের খুব বড় একটি দৈন্য। এরাRead More

attacks over blasphemy claim in Bangladesh

How much longer will the Muslim extremists in Bangladesh continue to oppress Hindus?

Ever since I became aware of the world around me in Bangladesh, I’ve witnessed violenceRead More

Comments are Closed