
Broken Traffic System in Dhaka
এদেশের রাস্তার ট্রাফিক কি আর কখনো সুস্থ হবে না ?
ভিডিওটি গাবতলীর পাশে মাজার রোডের মুখে একটি জেব্রা ক্রসিং। জেব্রা ক্রসিং মূলত পথচারী পারাপারের জন্য। নিয়ম হল এখানে পথচারীর প্রায়োরিটি বেশী। গাড়ি ব্রেক করবে, মানুষ পার হবে। জেব্রা ক্রসিং এর ২ পাশে সাধারনত স্পীড ব্রেকার থাকে। এখানে নেই। বাংলাদেশের প্রকৌশলী, জনপ্রতিনিধি, কর্তৃপক্ষ কেউ সাধারন পথচারীর কথা ভাবে না, হুইল চেয়ারধারী প্রতিবন্ধীদের কথা না হয় বাদই দিলাম। বাংলাদেশের কোন ফুটপাত হুইলচেয়ার মানুষের জন্য নয়। আর দেখুন, মানুষ, শিশু, নারী, বৃদ্ধ সবাই কিভাবে পার হয়। দ্রুতগামী সব বড় বড় বাহন যাচ্ছে, ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে মানুষও যাচ্ছে। আমি অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম এটাই এখানকার নিয়ম, ঢাকার শহরের অন্য সব জায়গার মতো। জেব্রা ক্রসিং বলে কেউ গাঁড়ির গতি কমাবে না। কেন যে এই জেব্রা ক্রসিং দেয়া হয় বাংলাদেশের মতো দেশের মানুষ, ড্রাইভার, হেল্পার এদের জন্য ?
বাংলাদেশের রাস্তায় ট্রাফিক আইনের প্রয়োগের কি দৈণ্যদশা সেটা এই কয়দিনে শিশু কিশোরদের আন্দোলনের বদৌলতে দেখেছেন নিশ্চয় ? একটু ক্ষমতা পেলেই ধরে নেয় সে আইনের উর্দ্ধে। আর পুলিশের তো ধারনাই এটা তাদের কোন লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন লাগে না। প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিবের ড্রাইভার, পানিসম্পদমন্ত্রীর ড্রাইভার, সংসদ সদস্যা পংকজ দেবনাথের ড্রাইভার, সাবেক ভূমি মন্ত্রীর ড্রাইভার, পুলিশের ডি আই জি’র ড্রাইভার, পুলিশ অফিসারদের কারো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই ! ভাবা যায়? এরা কেউ দাঁয় এড়াতে পারে না। তাদের গাড়িটা কে চালাচ্ছে, তার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে কিনা তারা কেউ সেটা খোঁজ রাখবে না ? কি দায়িত্বজ্ঞানহীন এক একজন ক্ষমতাধারী !
২৯ জুলাই আমার ৩ জন হজ্বযাত্রী আত্মীয়কে বিদায় জানানোর জন্য হজ্বক্যাম্প ও বিমানবন্দর গিয়েছিলাম। দুপুর থেকে রাত প্রায় ১০ টা পর্যন্ত ছিলাম ঐ এলাকায়। পথে দেখলাম কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনে অনেক গাড়ি ভাঙ্গা, কাঁচের টুকরা চারিদিকে। অবশ্য আগেই শুনেছিলাম ওখানে অনেক ছাত্র মারা গেছে এক্সিডেন্টে। এক্সিডেন্ট তো নয়, হত্যা। পরে রাত ৮ টার দিকে কিছুক্ষন দাঁড়িয়েছিলাম বিমানবন্দর ঢোকার মুখের পুলিশ বক্সটার সামনে। ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল একটি লাশবাহী এম্বুলেন্স ও অনেক ছাত্র ছাত্রী। ওরা সবাই দেখি কাঁদছে। জিজ্ঞেস করলাম একজনকে। জানালো তাদের বন্ধু মারা গেছে সেদিন। এও বললো আগামীকাল থেকে দেশের মানুষ দেখবে আন্দোলন কাকে বলে। আমি ততটা আশান্বিত হইনি। এই পুঁচকে ছেলে-মেয়েরা কি এমন আন্দোলন করবে ? হয়ত একদিন স্কুলের সবাই মানব বন্ধন করবে। এরপর শেষ।
আমার ধারনাকে ভুল প্রমান করে ওরা দেখিয়ে দিলো আমরা যা চেয়েছি, সড়কের নিরাপত্তা, নিরাপদ সড়ক তা আমরা বলতে পারিনি, দাবী করতে পারিনি। ওরা করে দেখিয়ে দিলো। সাবাশ এই বাঘের বাচ্চাদের। আইন প্রয়োগের দৈন্যকে ওরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখালো। অসংগঠিত শক্তির উত্থান আবার প্রত্যক্ষ করলাম গত কয়েক দিনে। কিশোর, এমনকি শিশুরাও এককাতারে এসে দাঁড়িয়েছে বেপরোয়া চালকের পরিণামচিন্তাহীন বাসচালনায় সহপাঠী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে। তারা শোক করেছে, আপত্তি জানিয়েছে, দাবি তুলেছে। শুধু তা-ই নয়, তাদের আন্দোলনের তৃতীয় দিন থেকে তারা রাস্তায় গাড়িঘোড়া চলায় শৃঙ্খলা আনতে চেয়েছে। বেআইনি চালকদের পুলিশে সোপর্দ করেছে, অনুমতিহীন গাড়ি আটকে রেখেছে। তারা একটি বা দুটি স্কুলের ছাত্র নয়, ঢাকার বহুসংখ্যক স্কুল-কলেজের বহুতর ছাত্রছাত্রীরা একযোগে পথে নেমেছে, দাবিনামা প্রণয়ন করে কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছে। যাঁরা বলছেন, সড়কপথে নিরাপত্তাবিধানের দায়িত্ব ছাত্রদের নয়, তাঁদের কথা স্বীকার করেও বলব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদের ব্যর্থতায় বা প্রশ্রয়ে সড়কপথে কী নৈরাজ্য চলছে, ছাত্ররা এক দিনে তা দেখিয়ে দিল। এরপরও কি আমাদের চোখ খুলবে না?
আজ কয়েকদিন ধরে বাচ্চারা ট্রাফিক সামলাচ্ছে। জিনিসটা আমার কাছে একেবারে মিথোলজিকাল লাগছে। সেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্পের মতো। এক ভোরে হাজার হাজার বাচ্চা নেমে এসেছে পথে, তাঁরা সারাদেশের বুড়োদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, কতটা নষ্ট হয়ে গেছে সিস্টেম। এই গল্প আরো অনেক অনেক বছর পর্যন্ত বলবার মতো গল্প।
এদেশের একশ্রেনীর রাজনৈতিক লোক আছে যারা নিজেরা মানুষের স্বার্থে কোন আন্দোলন করতে পারেনা, মাঝে মাঝে যা দু চারটা করে তাদের দূর্নীতিবাজ, রাজাকার নেতাদের মুক্তির জন্য, তাও জনসমর্থনহীন। তারা অন্য অনেক অসংগঠিত জনআন্দোলনের কাঁধে ভর দিয়ে তাদের কুট স্বার্থ হাসিল করতে চায়। এবারো এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। অন্যের গরম তা’য়ে রুটি ছেঁকে খাওয়ার ধান্দা। শিশুদের এই আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে নয়। তাদের যে দাবী দাওয়া এটা সকল বাংলাদেশীর প্রাণের দাবী বছরের পর বছর ধরে। অথচ ধান্দাবাজরা এর সুযোগ নিতে চায়। পৃথিবী একটা কুৎসিত জায়গা, এখানে ইবলিশের সাথে মানুষের লড়াই নিরন্তর। একটু অসতর্ক হলেই ধরা খাওয়ার আশঙ্কা।
প্রত্যেক আন্দোলনেরই একটা সেলফ লাইফ আছে। ফুল খুবই সুন্দর, কিন্তু এমনকি পানিভরা ফুলদানিতে রাখলেও একসময় সে ফুলের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। এটা অতীতে অনেকেই বুঝেনি, অনেককেই বুঝানো যায় নি-পরিণতিটা তাই সুন্দর হয়নি। এই কিশোর আন্দোলনের একটা সুন্দর যবনিকা টানতে হবে। বাচ্চারা তো দিনের পর দিন রাস্তায় ট্রাফিক সামলানোর কাজ করতে পারবে না।
এখন এই যবনিকা টেনে বাচ্চাদেরকে ঘরে ফেরানোর উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। যে তথাকথিত মোটরযান আইন সংশোধনের কথা শুনতে পাচ্ছি, বিদেশের আইনের সঙ্গে তুলনা করলে সেটা বাস্তবতার ধারেকাছের কোনো আইনই না। পুরো ট্রাফিক ব্যবস্থা কিভাবে ঢেলে সাজানো হবে তার একটা পরিস্কার রূপরেখা মিডিয়ার মাধ্যমে উপস্থাপন করলেই হয়তো আপাতত বাচ্চাদের হাতে বেইজ্জত হতে থাকা অথর্ব প্রশাসনের কিছুটা মান বাঁচে। ছেলে-মেয়েদের বিশেষ করে বয়/রোভার স্কাউট ও গার্লস গাইডদের স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে মাঝে মাঝে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রনে কাজে লাগানো যেতে পারে। এতে পুলিশ লজ্জায় পড়ে হলেও ঘুষ খাওয়া কমাতে পারে, তাদের উপরে চাপও কমবে।
বাংলাদেশে ভালো কোন দাবী বঙ্গবন্ধু কন্যা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খালি হাতে ফেরাবেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তিনি আন্তরিকভাবে চাইছেনও সড়ক নিরাপদ হোক। তিনি নিজেই অনেক কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন আরো আগেই। সড়ক-মহাসড়কে যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি গত জুনে পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেন তিন মন্ত্রীকে। ২৫ জুন এক বৈঠকে বৈঠকে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে পাঁচটি নির্দেশনা দেন। এগুলো হলো-
- এক. দূরপাল্লার পথে বিকল্প চালক রাখা। যাতে একজন চালককে টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি যানবাহন না চালাতে হয়।
- দুই. নির্দিষ্ট দূরত্বে সার্ভিস সেন্টার বা চালকদের জন্য বিশ্রামাগার করা।
- তিন. গাড়ির চালক ও তাঁর সহকারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া।
- চার. সিগন্যাল মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করা বা অবৈধভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা।
- পাঁচ. চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করা।
কিন্তু মাস পেরিয়ে গেলেও তিন মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে একটি বৈঠকও করেননি। আমাদের দূর্ভাগ্য যে সব কিছু নিয়ে তাকেই ভাবতে হয়।
মোটরযান আইনে বলা আছে, কোনো চালক একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি যানবাহন চালাতে পারবেন না। এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে দিনে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা গাড়ি চালাতে পারবেন তিনি। কিন্তু রাজধানী ঢাকার চালকেরা ফজরের আজানের পর শুরু করে রাত ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে থাকেন। আন্তজেলায় চলাচলকারী ট্রাকগুলো অনেক সময় দু-তিন দিন টানা রাস্তায় থাকে। ফলে চালকেরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ভারত ও ইউরোপের উদাহরণ দিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্বের পর বিশ্রামাগার রাখার কথাও বলেছিলেন। এই সমস্ত চিন্তা ও সিদ্ধান্ত কিন্তু তিনিই দিয়েছেন কারো চাওয়ার আগেই।
[ Cover Image, Edited | CC BY-SA 3.0 ]
Related Posts

Was this unexpected victory of Shibir in the DUCSU election actually expected?
At Dhaka University, Shibir is winning simply by securing votes – that’s the reality. AcrossRead More

ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের এই অপ্রত্যাশিত বিজয় কি প্রত্যাশিতই ছিল?
ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে শিবির ভোট পেয়েই জিতছে, এটাই বাস্তবতা। বাংলাদেশের সবক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্ট কিছু না কিছু ভুলRead More

১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন – বি এন পি যেভাবে গনতন্ত্র ধ্বংস করেছিল
২০২৪ এর ঐতিহাসিক গণ-অভভুত্থানের আগে ১৯৯০ সালে ছাত্র জনতার ত্যাগের বিনিময়ে দেশে গণতন্ত্র বিকাশের যেRead More
Comments are Closed