Supernova
supernova

Supernova

সুপারনোভাঃ তারাদের জীবনের শেষ কাহিনী

আমি সেই ১৯৯০ দশকের শেষদিক থেকে টুকটাক বিজ্ঞানের কথা বলি। তখন হাইস্কুলে পড়তাম। এরপর ২০০৬/০৭ সালের দিকে ব্যক্তিগতভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করলে ইয়াহু ম্যাসেঞ্জার, অর্কুট এমন কিছু মাধ্যমে আমার বেশ কযেকজন ভক্ত অনুরাগীও ছিল। যদিও বাংলাদেশে বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা খুব কম। যেখানে রাজনীতি, ধর্ম, মুখস্তবিদ্যা এসবকে সমাজে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চর্চা করা হয় সেখানে বিজ্ঞানের বিষয়ে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা ২/১ জন থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ঠিক এ কারনেই হয়ত আরো এক শতাব্দী বাঙালীদের কামলা হিসাবেই টিকে থাকতে হবে বিশ্বপরিসরে। যে জাতি এখনো শ্যাওড়া গাছের পেত্নীতে ভরসা রাখে তাদের জন্য সুপারনোভা হলো জীন, ভূত, দৈত্য, দানব, অসুরদের কাজ। অনেকে আবার বিজ্ঞান ও ধর্মকে মিলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক থিওরি পরিবর্তনশীল, আজকের এক থিওরিকে কালকে অন্য থিওরি দিয়ে ভুল প্রমান করা যেতে পারে, কিন্তু ধর্মীও বিষয়গুলো অপরিবর্তনশীল। সুতরাং বিজ্ঞানকে ধর্মীও দৃষ্টিতে মিলানোর চেষ্টা নিতান্তই শিশুসুলভ ও অশিক্ষিত মানসিকতা! যাই হোক ফিরে আসি সুপারনোভায়।

তারারা আমাদের মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় ও শক্তিশালী বস্তুগুলোর মধ্যে একটি। এদের জন্ম, জীবন, এবং মৃত্যু – সবকিছুই মহাকাশের গভীর গাণিতিক ও পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মে বাঁধা। আর এই মৃত্যুর সবচেয়ে নাটকীয় রূপ হলো সুপারনোভা – এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ যা শুধু একটি তারার জীবন শেষ করে না, বরং নতুন তারার জন্মের পথও খুলে দেয়।

সাধারণভাবে, তারারা বেঁচে থাকে নিউক্লিয়ার ফিউসনের মাধ্যমে। হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসগুলো একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে যুক্ত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে, এবং এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়। এই শক্তিই তারাকে আলো দেয়, তাপ দেয়, এবং মহাবিশ্বে তার উপস্থিতি জানান দেয়। আমাদের সূর্যও এই একই প্রক্রিয়ায় জ্বলছে – কোটি কোটি বছর ধরে।

তবে এই ফিউসন পৃথিবীতে স্বাভাবিকভাবে সম্ভব নয়। কারণ এর জন্য প্রয়োজন হয় কয়েক কোটি কেলভিন তাপমাত্রা এবং নিউক্লিয়াসের ঘনত্ব এত বেশি, যা পৃথিবীর কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশে পাওয়া যায় না। আমরা যখন কোনো বস্তু ছুঁই, আসলে আমরা তার নিউক্লিয়াস ছুঁই না – ইলেকট্রনদের বলই আমাদের স্পর্শের অনুভূতি দেয়। কিন্তু তারার ভেতরে এত তাপ থাকে যে ইলেকট্রনরা নিউক্লিয়াস থেকে আলাদা হয়ে যায়, এবং নিউক্লিয়াসরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। এই অবস্থায় তারা সংঘর্ষে যুক্ত হতে পারে – এবং ফিউসন সম্ভব হয়।

মানুষ এই প্রক্রিয়াকে অনুকরণ করেছে হাইড্রোজেন বোমায়, যেখানে অনিয়ন্ত্রিত ফিউসন ঘটে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ফিউসন সফলভাবে করা যায়নি। গবেষণা চলছে, কারণ যদি সফলভাবে নিয়ন্ত্রিত ফিউসন করা যায়, তাহলে তা হবে শক্তির এক বিপ্লব – যেখানে ইনপুটের চেয়ে আউটপুট শক্তি বেশি হবে।

তারার কেন্দ্রস্থলে নিউক্লিয়ার ফিউসনের ফলে যে শক্তি উৎপন্ন হয়, তা প্রথমে গামা রশ্মি হিসেবে বের হয়। কিন্তু সূর্যের মতো তারার ঘনত্ব এত বেশি যে এই গামা রশ্মিগুলো সহজে বাইরে আসতে পারে না। তারা ইলেকট্রনের সঙ্গে সংঘর্ষে শক্তি হারায়, দিক বদলায়, এবং ধীরে ধীরে কম শক্তির আলোককণায় রূপান্তরিত হয়। এইভাবে সূর্যের ভেতর থেকে একেকটি আলোককণার বাইরে আসতে হাজার হাজার বছর লেগে যায়।

এই আলোককণাগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষে ইলেকট্রনগুলোও উত্তপ্ত হয়, এবং এই উত্তাপের ফলে সূর্যের ভেতরে একটি চাপ তৈরি হয়, যা তারাকে নিজের মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে রাখে। এই চাপ না থাকলে তারা সংকুচিত হয়ে যেত, এবং ফিউসন থেমে যেত।

ফিউসনের মাধ্যমে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম, তারপর কার্বন, অক্সিজেন ইত্যাদি তৈরি হয়। একসময় আয়রন তৈরি হলে ফিউসন থেমে যায়, কারণ আয়রনের পর আর শক্তি পাওয়া যায় না। তখন তারার ভেতরে ভারসাম্য নষ্ট হয় – মাধ্যাকর্ষণ তাকে সংকুচিত করতে থাকে, আর ফিউসনের চাপ তাকে ঠেকাতে পারে না। এই অবস্থায় ঘটে সুপারনোভা – এক ভয়ংকর বিস্ফোরণ যা তারার উপাদানগুলো মহাশূন্যে ছড়িয়ে দেয়।

এই বিস্ফোরণ এত তীব্র যে একেকটি কণা এক সেকেন্ডে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যেতে পারে। এই ছড়িয়ে পড়া পদার্থ উত্তপ্ত হয়ে আলো দেয়, তাই সুপারনোভা দৃশ্যমান হয়। প্রথমে দৃশ্যমান আলো দেখা যায়, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে বিস্ফোরণ ছড়িয়ে পড়ে, ঠাণ্ডা হয়, এবং ইনফ্রারেড আলোতে রূপ নেয়।

তবে সুপারনোভা অনেক দূরে থাকায় আমরা মাসের পর মাস তা দেখতে পাই। বেশিরভাগ সুপারনোভা কয়েক মেগাপারসেক দূরে থাকে – এক মেগাপারসেক মানে প্রায় ৩০ লক্ষ আলোকবর্ষ। তাই এত দূরত্বের কারণে আমরা তা দুরবীন দিয়ে দেখতে পারি।

শেষবার কোনো সুপারনোভা খালি চোখে দেখা গিয়েছিল ১৬০৪ সালে, যখন জ্যোতির্বিদ কেপলার আমাদের ছায়াপথে ঘটে যাওয়া একটি বিস্ফোরণ নিজে দেখেছিলেন এবং তা লিখে রেখেছিলেন।

এই বিস্ফোরণ শুধু একটি তারার মৃত্যু নয় – এটি মহাবিশ্বে নতুন উপাদান ছড়িয়ে দেয়, যা ভবিষ্যতের গ্রহ, প্রাণ, এবং সভ্যতার ভিত্তি হতে পারে। তাই সুপারনোভা শুধু ধ্বংস নয়, এক নবজন্মের বার্তা।

Related Posts

Sunlight and Human Body

Sunlight: A Natural Medicine, Cultural Wisdom, and the Key to Healthy Longevity

For thousands of years, many civilizations have worshipped the sun as a deity – notRead More

Sunlight and Vitamin-D

সূর্যের আলো: প্রাকৃতিক ঔষধ, সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকর দীর্ঘায়ুর চাবিকাঠি

হাজার হাজার বছর ধরে অনেক সভ্যতা সূর্যকে দেবতা মানে; শুধু বৈদিক, পৌরাণিক, এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য,Read More

Evolutionary Biology and Women

Protecting women is a man’s responsibility – this is a lesson rooted in evolutionary psychology

A common tendency across all societies is to take extra care of women. This isRead More

Comments are Closed