No Profession is Small
কারো পেশাকে ছোট করবেন না, বরং তার অধিকার নিশ্চিত করুন
বাঙ্গু সুশীল মিডিয়া ও সমাজের ন্যারেটিভ দেখেন! এটা বাংলাদেশের মানুষের খুব বড় একটি দৈন্য। এরা পেশাকে ছোট করে দেখে। একটি শিশুর বাবাকে খুন করা হয়েছে, রাষ্ট্র কোন প্রটেকশান দিতে পারেনি, তার পরিবারের জন্য সমাজ, রাষ্ট্র কোন দায়িত্ব নেয়নি। এই নষ্ট, পঁচে যাওয়া রাষ্ট্র ও সমাজের চোখে এই শিশুর জুতা সেলাই করা মুচির পেশায় ফিরে যাওয়াটা খুব অমানবিক! বিষয়টা এমন সে যদি কোন ডাক্তারের হেল্পার হতো বা স্কুলের পিওন হতো তবে সেটা হতো খুব গৌরবময়!
কয়েকদিন ধরে প্রচার চালানো হলো সে তার বাবার পেশায় ফিরে গেছে – সেটা খুব অমানবিক। বাবার পেশায় ফিরে যাওয়াটা অমানবিক না, অমানবিক হলো রাষ্ট্রের জঘন্য চরিত্র যেখানে সদ্য তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি খুন হওয়ার পরে একটি শিশুকে পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে কাজে নামতে হয়। পেশাকে ছোট করা অন্যায়। সে বা তার পরিবার মুচি, জুতা সেলাই করে সেটা কোন ছোট কাজ নয়, আইনজীবী হওয়াটাও তেমন এমন কিছু গৌরবজনক নয়।
প্রত্যেক শিশুর সার্বজনীন অধিকার শিক্ষা পাওয়ার, তার পেটে পরিমানমতো খাবার যাবে, সে বেড়ে উঠার সুন্দর একটি পরিবেশ পাবে এটাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সে বড় হয়ে আবার বাবার পেশা বেছে নিবে নাকি আইনজীবী হবে সেটা বড় বিষয় না। রাষ্ট্র তার বাবার খুনের নায্য বিচার করবে, তার ও পরিবারের দায়িত্ব নিবে, তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন এসবের ব্যবস্থা করবে এটাই সভ্য রাষ্ট্রের কর্তব্য।
এভাবে প্রায় প্রায় নিউজ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রিক্সা চালিয়ে খরচ জোগাচ্ছে। দেশের বড় বড় লেখক বা বুদ্ধিজীবিরা সেই ব্যক্তির জীবন সংগ্রাম নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। রিক্সা চালানো খারাপ কিছু? ১৮ বছরের একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ যে কোন কাজ করবে, তাতে অসম্মানের কি আছে? মুচি হোক, মেথর হোক, ডোম হোক – সব পেশাই সম্মানের। বরং তথাকথিত সম্মানজনক পেশার লোকজন যারা দেশে দুর্নীতি করে, লুটপাট করে, শোষন করে, অন্যায় করে, সম্পদ পাচার করে, ন্যায়বিচার বিঘ্নিত করে, মানুষকে দাস বানিয়ে রাখে – তারাই সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্যান্সার, সেগুলো কেটে ফেলে দেয়াটাই রাষ্ট্রের কর্তব্য।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, একজন শিক্ষিত ব্যক্তিকে রিক্সা বা মোটরসাইকেল চালাতে দেখলে বা জুতা সেলাই করা মুচির কাজ করতে দেখলে আপনাদের কষ্ট লাগে, কিন্তু একজন অশিক্ষিত ব্যক্তিকে একই কাজ করতে দেখলে আপনাদের কষ্ট লাগে না কেন? অশিক্ষিত হলে তাকে কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের, আপনাদের ভাষায় নোংরা কাজগুলো করতে হবে?
রিক্সা বা মোটরসাইকেল চালানো কি অশিক্ষিতদের কাজ? এই কাজটা তো শিক্ষিতদের জন্যই নির্ধারিত হওয়া উচিত। কারণ, এই যানবাহনগুলো চালানোর জন্য একজন চালককে সঠিকভাবে ট্রাফিক আইন এখন সড়কের অসংখ্য নিয়ম-কানুন জানতে হয়, যা একজন অশিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষে জানা অসম্ভব।
কোনো কাজই ছোট বা অসম্মানের নয়। শারীরিক পরিশ্রমের কাজগুলো শুধুই অশিক্ষিত বা কম শিক্ষিতরা করবে, এটা গত শতাব্দীর ধারণা। আর অশিক্ষিত শ্রমিকদেরকে কথায় কথায় চড় থাপ্পড় মারা যায় বা তাদের সঙ্গে দূর্ব্যবহার করা যায়, এটা ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতি। এই ধারণা এবং আদিম সংস্কৃতি নির্মুল করার জন্য সকল পেশায় শিক্ষিতের অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
আপনারা যারা বাংলাদেশেকে কথায় কথায় ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করে সুখ পান, তাদের জানা উচিত, বাংলাদেশের বেশিরভাগ উচ্চ শিক্ষিত প্রবাসীরা ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে শারীরিক কঠোর পরিশ্রমের কাজগুলো করেই সুপ্রতিষ্ঠিত হন। আবার ইউরোপ-আমেরিকায় শারীরিক পরিশ্রম করা প্রায় সব শ্রমিকরাই শিক্ষিত বা উচ্চ শিক্ষিত। ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত আর শিক্ষিত দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশীরভাগ ছাত্ররাই তাদের ছাত্র জীবনের খরচ চালায় পড়াশোনার পাশাপাশি হাঁড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ করে। রাতের বেলা বা উইকেন্ডে রেস্টুরেন্টে, ম্যাকডোনাল্ডসে বা কেএফসিতে কাজ করে নিজের পড়াশোনার খরচ উপার্জন করা এসব দেশে স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেক কোটিপতি, মন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের সন্তানেরাও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য ছাত্রজীবনে রেস্টুরেন্টে বা দোকানে কাজ করে। পিএইচডি ছাত্রকে ভোর ৪টা থেকে পত্রিকা বিলির কাজ করে তারপর তাকে গবেষণার কাজে যেতে দেখেছি।
কাজ বা শ্রমের বিষয়ে একটা দেশের শিক্ষিতরাই যদি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলান, তাহলে সমাজ বদলাবে কিভাবে? পরিশ্রম বা কাজের প্রতি অশ্রদ্ধা ভারতীয় উপমহাদেশের এক বিরাট সাংস্কৃতিক অসুখ। হুমায়ুন আহমেদের নাটকের সংলাপটা খুবই প্রাসঙ্গিক – “মামা, আমাগো তো চুরি করা ছাড়া উপায় নাই। রিক্সা চালাইলে দশজনে দেখবো। কিন্তু চুরি করলে দেখবো কেডায়?”
শিক্ষিত হওয়া মানে কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া নয়। শিক্ষিত লোক কাজকে সহজ, সুন্দর ও দ্রুত করতে শিখে। যেমন একজন অশিক্ষিত মুচি যদি দিনে ১০টি জুতা বানাতে পারে, একজন শিক্ষিত মুচি দিনে হাজার হাজার জুতা বানাতে পারে, তাও আবার বিভিন্ন ডিজাইনের।
কোন পেশাকে ছোট করার, ছোটলোকের পেশা হিসাবে বিবেচনা করার এই সমস্ত ন্যারেটিভ বাদ দিতে হবে। প্রশ্ন হবে শিশুটি কেন বাবাকে হারালো? শিশুটিকে কেন এই বয়সে তার শিক্ষা, খাদ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে উপার্জনে নামতে হলো? সেখানে তার বাবার পেশাকে ছোটলোকের পেশা দেখানোর এই সমস্ত ন্যারেটিভ বাদ দিতে হবে।
রাষ্ট্র এই শিশুর পরিবারের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করুক, তার পরিবারের দায়িত্ব নিক।
Related Posts
In the Shadow of Famine: Bengali Food Habits – History, Practice, and Bodily Burden
About 10-12 days ago.I went to a large wholesale store, where products are usually soldRead More
দূর্ভিক্ষের ছায়ায় বাঙালির খাদ্যাভ্যাসঃ ইতিহাস, অভ্যাস ও শরীরের দায়
প্রায় ১০-১২ দিন আগের ঘটনা। একটি বড় বিপণিবিতানে গিয়েছিলাম, যেখানে সাধারণত বক্স ধরে পণ্য কিনতেRead More
Are religion, country, race, patriotism, and nationalism all racist concepts?
The only uncontacted human tribe left in the world today are the Sentinelese of NorthRead More

Comments are Closed