
Last day of Earth!
২১ ডিসেম্বর ২০১২ঃ পৃথিবীর শেষ দিন নাকি শুধুই এক গুজব?
একটা দিন, একটা তারিখ, আর এক পৃথিবীজোড়া আতঙ্ক। ২১ ডিসেম্বর ২০১২ – এই দিনটিকে ঘিরে এমন এক গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, যা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মানুষের মনে ভয়, কৌতূহল আর ষড়যন্ত্রের গল্প বুনে গেছে। কেউ বিশ্বাস করেছে, কেউ হাস্যকর ভেবেছে, কেউ আবার প্রস্তুত হয়ে আছে শেষ দিনের জন্য। কিন্তু এই গুজবের জন্ম কোথায়? কেন মানুষ এতটা আতঙ্কিত হয়েছিল? আর বিজ্ঞান কী বলেছিল? চলুন ফিরে যাই সেই সময়ের পেছনে, যেখানে ইতিহাস, মিডিয়া, বিজ্ঞান আর কল্পনার মিশেলে তৈরি হয়েছিল এক বৈশ্বিক মিথ।
📺 শুরুটা টিভি স্ক্রিনে
২০০৬ সালে History Channel প্রচার করে একটি তথ্যচিত্র – “Decoding the Past: Mayan Doomsday Prophecy”। সেখানে বলা হয়, মায়ান সভ্যতার ক্যালেন্ডার ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর শেষ হবে, আর সেই সঙ্গে ঘটবে এক ভয়াবহ মহাপ্রলয়। এরপর Discovery Channel-এর “2012 Apocalypse” এবং হলিউডের “২০১২” সিনেমা – সব মিলিয়ে যেন এক বৈশ্বিক আতঙ্কের নাট্যমঞ্চ তৈরি হয়ে যায়।
সিনেমার দৃশ্যগুলো ছিল ভয়াবহ – ভূমিকম্পে শহর ধ্বংস, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে নগরীতে। বাস্তবের সঙ্গে মিল না থাকলেও, মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল।
🌌 ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উত্থান
ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে নানা গুজব – Nibiru নামের এক অজানা গ্রহ পৃথিবীতে ধেয়ে আসছে, NASA সব জানে কিন্তু গোপন করছে, সৌরঝড় পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র ধ্বংস করে দেবে। কেউ বলছে, সব গ্রহ এক সরলরেখায় চলে আসবে, কেউ বলছে পৃথিবীর অক্ষ উলটে যাবে।
Nibiru বা Planet X-এর মতো গ্রহের অস্তিত্ব নিয়ে এতটাই গুজব ছড়ায় যে NASA-কে আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিতে হয়: “এইসব ধারণা মনগড়া, বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীন।”
📜 মায়ান ক্যালেন্ডার: সময়ের চক্র, ধ্বংস নয়
মায়ান সভ্যতা নিয়ে গবেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। Tulane University-এর Marcello Canuto এবং University of Kansas-এর John Hoopes জানাচ্ছেন – মায়ানদের Long Count ক্যালেন্ডারে ২১ ডিসেম্বর ২০১২ ছিল ১৩তম “বাকতুন”-এর শেষ দিন। এটি একটি সময়চক্রের সমাপ্তি, ধ্বংসের কোনো ইঙ্গিত নয়।
মেক্সিকোর National Institute of Anthropology and History-এর পরিচালক Carlos Palan বলেন, “১৫ হাজারের বেশি মায়ান গ্রন্থে কোথাও ২০১২ সালের ধ্বংসের কথা নেই। এটি ১৯৭০-এর দশকে কিছু দুর্বোধ্য লেখার ভুল ব্যাখ্যা থেকে ছড়ানো গুজব।”
🔬 বিজ্ঞান কী বলছে?
NASA একে একে তুলে ধরেছে ছয়টি যুক্তি, যা এই গুজবকে খণ্ডন করে:
১. Nibiru বা Planet X
যদি এই গ্রহ সত্যিই থাকতো, তাহলে জ্যোতির্বিদরা বহু আগেই তা আবিষ্কার করতেন। Eris নামের একটি বাস্তব গ্রহ থাকলেও তা পৃথিবী থেকে ৪ বিলিয়ন মাইল দূরে, এবং তার কক্ষপথ পৃথিবীর জন্য হুমকি নয়।
২. গ্রহের সারিবদ্ধতা
সৌরজগতের সব গ্রহ একই সরলরেখায় আসার সম্ভাবনা নেই। আর এলেও, তা পৃথিবীতে কোনো প্রভাব ফেলবে না। প্রতিবছর ২১ ডিসেম্বর সূর্য, পৃথিবী ও আকাশগঙ্গার কেন্দ্র প্রায় একই রেখায় থাকে – কিন্তু কোনো বিপর্যয় ঘটে না।
৩. সৌরঝড়
প্রতি ১১ বছর পরপর সৌরঝড় হয়, যা স্যাটেলাইটে সাময়িক প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু তা পৃথিবী ধ্বংসের কারণ নয়। বরং এটি সৃষ্টি করে মেরুপ্রভা – রঙিন আকাশের দৃশ্য।
৪. পৃথিবীর অক্ষ পরিবর্তন
পৃথিবীর ঘূর্ণন বা অক্ষ হঠাৎ উলটে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। চৌম্বক বলয়ের পরিবর্তন হয়, কিন্তু তা বিপর্যয় ডেকে আনে না।
৫. অগ্ন্যুৎপাত
Yellowstone বা Long Valley-এর অতীত অগ্ন্যুৎপাত বড় হলেও, এমন কোনো অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাবনা নেই যা গোটা পৃথিবী ধ্বংস করে ফেলবে।
৬. গ্রহাণু বা ধূমকেতু
NASA-র Spaceguard Survey নিয়মিত পৃথিবীর নিকটবর্তী বস্তু পর্যবেক্ষণ করে। এখন পর্যন্ত এমন কোনো বস্তু পাওয়া যায়নি যা পৃথিবী ধ্বংস করতে পারে।
📊 জনমত: ভয়, বিশ্বাস, আর বাস্তবতা
২০১২ সালের শেষদিকে, এক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য – প্রায় ১০% মানুষ বিশ্বাস করছে ২১ ডিসেম্বরেই পৃথিবীর শেষ দিন। কেউ ভাবছে, সূর্যের পৃষ্ঠে ভয়াবহ সৌরঝড় সৃষ্টি হবে, যা পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রকে ধ্বংস করে দেবে। কেউ আবার Planet X বা Nibiru নামের এক রহস্যময় গ্রহের সংঘর্ষে পৃথিবী ধ্বংস হবে বলে আশঙ্কা করছে। আরেক দল বিশ্বাস করছে, সৌরজগতের সব গ্রহ এক সরলরেখায় চলে আসবে, যার ফলে মহাজাগতিক ভারসাম্য ভেঙে পড়বে।
এই বিশ্বাস শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই – অনেক মিডিয়া, ইউটিউব চ্যানেল, এমনকি কিছু লেখকও এই ভয়কে পুঁজি করে বই, ভিডিও, এবং প্রবন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে। “Doomsday Preppers” নামের একটি রিয়েলিটি শো পর্যন্ত তৈরি হয়েছে, যেখানে মানুষ দেখাচ্ছে কীভাবে তারা পৃথিবীর শেষ দিনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
✍️ ভয় নয়, যুক্তি দিয়ে ভাবুন
এই ঘটনা আমাদের শেখায় – ভয় নয়, যুক্তি দিয়ে ভাবা উচিত। ইতিহাস, বিজ্ঞান, আর সংস্কৃতির সম্মিলনে গড়ে ওঠা এই গুজব একদিন থেমে যাবে। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব – ভবিষ্যতের গুজবগুলোকে যুক্তি দিয়ে মোকাবিলা করা।
আপনি যদি এই লেখাটি পছন্দ করে থাকেন, তাহলে শেয়ার করুন, মন্তব্য করুন, আর ভাবুন – আমরা কীভাবে তথ্যের আলোয় ভয়কে জয় করতে পারি।
————————————-
ফলো-আপঃ ডিসেম্বর ২৩, ২০১২
🕊️ ২১ ডিসেম্বর পার হলো, পৃথিবী রইলো অক্ষত
শেষ পর্যন্ত ২১ ডিসেম্বর ২০১২ পার হয়ে গেলো। পৃথিবী রইলো অক্ষত। সূর্য উঠলো, মানুষ কাজে গেলো, আর বিজ্ঞান হাসলো। মায়ান ক্যালেন্ডারের নতুন চক্র শুরু হলো – যেমনটা তারা চেয়েছিল, যেমনটা তারা বিশ্বাস করতো।
Related Posts

Sunlight: A Natural Medicine, Cultural Wisdom, and the Key to Healthy Longevity
For thousands of years, many civilizations have worshipped the sun as a deity – notRead More

সূর্যের আলো: প্রাকৃতিক ঔষধ, সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকর দীর্ঘায়ুর চাবিকাঠি
হাজার হাজার বছর ধরে অনেক সভ্যতা সূর্যকে দেবতা মানে; শুধু বৈদিক, পৌরাণিক, এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য,Read More

Protecting women is a man’s responsibility – this is a lesson rooted in evolutionary psychology
A common tendency across all societies is to take extra care of women. This isRead More
Comments are Closed