 
						Is Dhaka a Planned City?
আমার বর্তমান শহরের নগর পরিকল্পনা ঢাকার থেকে বহুগুণ এগিয়ে
গতমাসের ৫ তারিখ ছিল এক ঝকঝকে, নির্মল রৌদ্রউজ্জ্বল দিন – আকাশে মেঘের ছায়া নেই, বাতাসে ছিল একধরনের সতেজতা। ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করার পরে দীর্ঘ ২৫ ঘণ্টা পেরিয়ে আমার প্লেন যখন এই অচেনা, অজানা শহরের আকাশে প্রবেশ করল, তখনই মনে হলো – জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে। বহু বসন্ত পেরিয়ে, বহু স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা পেছনে ফেলে, আমি পা রাখছি এমন এক শহরে, যেখানে আমার নতুন জীবন শুরু হবে। জীবনের অনেক বছর আমি কাটিয়েছি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শহর, রাজধানী ঢাকা শহরে। যদিও বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রাম ও ঢাকা মিলিয়ে আমার শৈশব, কৈশোর ও কর্মজীবনের অনেক অধ্যায় জড়িয়ে আছে, তবুও ঢাকা কখনোই আমার কাছে প্রিয় শহর হয়ে ওঠেনি। মানবিক শহর বলতে যা বোঝায়, নাগরিকদের জন্য যে শহর নিরাপদ, সহজ, সুশৃঙ্খল – ঢাকা তার থেকে বহু দূরে। এখন নামছি নতুন এক শহরে, এই শহর সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তই হবে যেন এক নতুন আবিষ্কার। আকাশ থেকেই দেখা যাচ্ছিলো শহরের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, পার্ক, সবকিছু যেন এক ছকে বাঁধা। ইউনিভার্সিটির পাঠ্যবইয়ে পড়েছি গ্রীড-আইরন প্যাটার্নের কথা, যা প্রাচীন গ্রীক সভ্যতায় নগর পরিকল্পনার ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। সেই প্যাটার্ন এখনো আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনায় কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই সুন্দর পরিকল্পনা আমার চোখের সামনে, বাস্তবে দেখে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। বারবার মনে পড়ছিলো ঢাকা শহরের এলোমেলো, অগোছালো, বলা যায় পরিকল্পনাহীন রাস্তাঘাটের কথা – যেখানে প্রতিদিন মানুষকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। একজন নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে প্রথম দর্শনেই বুঝে গিয়েছিলাম, ঢাকার তুলনায় এই শহরের পরিকল্পনা অনেক বেশি উন্নত, যদিও ঢাকার বয়স তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
ঢাকা শহরের অগোছালো পরিকল্পনা, কিংবা বলা যায় পরিকল্পনার অভাব, তাকে এই শহরের তুলনায় অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। এখানে বসবাস শুরু করে প্রতিদিনই বুঝতে পারছি, একটি শহরের পরিকল্পনা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কতটা প্রভাব ফেলে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। জীবনকে কতটা সহজ, গতিশীল ও নিরাপদ করে তুলতে পারে একটি সুপরিকল্পিত নগর – এই শহর তার জীবন্ত উদাহরণ। প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি মোড়, প্রতিটি স্থাপনা যেন এক সুসংহত নকশার অংশ। এখানে চলাফেরা করতে গিয়ে মনে হয়, শহরটি যেন নাগরিকদের জন্যই তৈরি – তাদের সুবিধা, নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যকে প্রাধান্য দিয়ে।
এখানে রাস্তাগুলোর কানেক্টিভিটি এতটাই গোছানো যে আপনি গুগল ম্যাপ দেখে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সহজেই পৌঁছে যেতে পারবেন। গ্রীড-আইরন প্যাটার্নের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো – একটি রাস্তা দিয়ে ঢুকে আপনি সহজেই অন্য রাস্তায় পৌঁছে যেতে পারবেন, ডেড এন্ড নেই বললেই চলে, প্যাঁচানো রাস্তাও চোখে পড়ে না। অন্যদিকে ঢাকার রাস্তায় নতুন কেউ গেলে, আর সে যদি সঠিক দিক নির্দেশনা না জানে, তবে তার পক্ষে সঠিক গন্তব্যে যাওয়া অত্যন্ত কষ্টকর। ঢাকায় ডেড এন্ড যেন নিত্যদিনের সঙ্গী, মাঝে মাঝে রাস্তা প্রশস্ত হয়ে আবার সরু হয়ে যায়, যা যান চলাচলে বড় বাধা সৃষ্টি করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, এই শহরে আপনি যে কোনো মেট্রো স্টেশন বা সাবওয়েতে সরাসরি পৌঁছাতে পারবেন, কিন্তু ঢাকায় কোনো বাস টার্মিনালে যেতে হলে আপনাকে অনেক ঘুরে-প্যাঁচিয়ে যেতে হবে। এমনকি আপনি গুগল ম্যাপের মতো আধুনিক টুলস ব্যবহার করেও ঠিকমতো এগোতে পারবেন না, যদি না কেউ আপনাকে সাহায্য করে। সেদিক দিয়ে এই শহরের রোড নেটওয়ার্ক এতটাই গোছানো যে আপনি একা, নির্ভরযোগ্যভাবে, প্রযুক্তির সহায়তায় চলাচল করতে পারবেন।
এই শহরের বেশিরভাগ রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের ঝামেলা নেই বললেই চলে। এখানে রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যাল আছে, সবাই তা মেনে চলে, কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয় না। এর ফলে মানুষের জীবনে গতি বজায় থাকে, সময়ের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়। একদিকে এটি মানুষের শত শত কর্মঘণ্টা বাঁচায়, অন্যদিকে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে তরান্বিত করে। এটি একটি সুন্দর পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার প্রতিফলন। অন্যদিকে ঢাকায় প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তার স্বল্পতা, ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত ট্রাফিক ব্যবস্থা, জনগণের ট্রাফিক আইন না মানা এবং গণপরিবহণ ব্যবস্থার দুর্বলতা – সব মিলিয়ে প্রতিদিন সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ যানজট। যানজটের কারণে মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে, কর্মক্ষমতা ও মনোযোগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শিক্ষার্থী, কর্মজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিদিন নাকাল হচ্ছেন। যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য এক বিশাল ক্ষতি। ২০০৪ সালে ঢাকায় যানবাহনের গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ৭ কিলোমিটারে। গণপরিবহন ব্যবস্থায় এক ধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে, যেখানে যাত্রীদের জন্য নেই পর্যাপ্ত বাস, নেই নির্দিষ্ট রুট, নেই সময়ানুবর্তিতা। পথচারীদের চলাচলের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা উচিত, তার অনেকটাই অনুপস্থিত। যতটুকু আছে, সেখানেও হকাররা পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের ‘ম্যানেজ’ করে বসায় দোকানপাট, বাজার। রাস্তায় প্রভাবশালীদের নির্মাণ সামগ্রী স্তুপ করে রাখা তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
এখন যেই শহরে আছি, এটি পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ শহর হলেও ঢাকার তুলনায় অনেক কম ঝুঁকিপূর্ণ। এখানকার অধিকাংশ ঘরবাড়ি কাঠ দিয়ে তৈরি, যা এক ধরনের স্থানীয় প্রযুক্তি। এটি একদিনে রপ্ত হয়নি, বরং শত শত বছরের অভিজ্ঞতা, বড় বড় ভূমিকম্পের ধাক্কা, ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে এই প্রযুক্তি স্থায়ী হয়েছে। এখানে ঘরবাড়ি তৈরির নীতিমালা কঠোরভাবে মেনে চলা হয়, মানুষও নিজের নিরাপত্তা নিয়ে অত্যন্ত সচেতন। নিকট অতীতে এখানে বড় কোনো দুর্ঘটনা বা তা থেকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ চোখে পড়েনি। অন্যদিকে ঢাকা অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় সেখানে বড় আকারের অঘটন ঘটলে, যেমন বড় ভূমিকম্প হলে যে পরিমাণ ক্ষতি হবে, তা হবে অকল্পনীয়। ঢাকাকেন্দ্রিক নগরায়ণ টেকসই নয়, যা প্রত্যেক সচেতন নাগরিকই উপলব্ধি করেন। কিন্তু মানুষ চাইলেই যেখানে সেখানে বহুতল কংক্রিটের ভবন নির্মাণ করতে পারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্নীতিবাজ কর্মচারীরা ঘুষ নিয়ে এসবের বৈধতা দেন, পরবর্তীতে কোনো তদারকি করেন না। ঢাকা শহরে একটি ল্যান্ড ইউজ প্ল্যান আছে বটে, কিন্তু তা কেউ মেনে চলে বলে প্রতীয়মান হয় না। ২০১৩ সালে ঢাকার অদূরে সাভারে একটি ভবন ধসে পড়ে ১৩০০-এর অধিক গার্মেন্টস কর্মীর নির্মম মৃত্যু ঘটে, যা রানা প্লাজা দুর্ঘটনা নামে পরিচিত। এই ঘটনা সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিলো, কিন্তু তারপরও অপরিকল্পিত, অরক্ষিত নগরায়ণ থেমে নেই।
নাগরিক সুবিধার কথাও যদি বলা হয় সেখানেও আমার এই বর্তমান শহরের মানুষ অনেক ভালো আছে। এখানে রাস্তাগুলো অনেক প্রশস্ত, বহুতল ভবন নেই বললেই চলে। এ কারনে এখানে নাগরিক সুবিধার পরিকল্পনা করা সহজ। এখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ২৯১০ জন মানুষের বাস। এখানে সবাই ২৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস পায়। আমি এখনো কোনদিন বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখিনি। আগুন লাগলে বা দূর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিস বা উদ্ধারকর্মীরা দ্রুত পৌঁছে যেতে পারবেন। এখন যদি ঢাকার কথা বলা হয় তবে আমরা দেখবো সেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৪৩২২৩ জন মানুষ বাস করছে। একটা ২০ তলা বিল্ডিং তো তার পাশেই একটি কুঁড়েঘর বা সারি সারি বস্তি। সেখানকার রাস্তাগুলো খুবই সরু, ভাঙ্গাচোরা, অরক্ষিত। বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা সেখানে। পানি থাকে না দিনের অনেক সময়, গ্যাসের অভাবে সবাই ঠিকমতো রান্না করতে পারে না। অন্য আরো অনেক নাগরিক অধিকারের কথা নাইবা বললাম এই স্বল্প পরিসরে। বিশ্বের অন্যতম (বর্তমানে ১১তম) মেগাসিটি হিসেবে ঢাকা শহরের শৃঙ্খলহীনভাবে বৃদ্ধি ও বিকাশ নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির সহায়ক নয়।
ঢাকা শহর তার প্রাপ্ত সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারেনি বা পারে না। প্রাকৃতিকভাবে ঢাকা শহর অনেকগুলো ছোট বড় নদী দিয়ে পরিবেষ্টিত। এই নদীগুলো হতে পারতো ঢাকা শহরের চলাচলের প্রধানতম মাধ্যম, যা হয়নি। দূষন, দখল, দুর্নীতি ও সমন্বয়হীনতায় এগুলো এখন মৃতপ্রায়। বছরে অনেকদিন বৃষ্টি হওয়ায় ঢাকা শহরে পানি ও নদীর প্রবাহে সমস্যা হওয়ার কথা ছিলো না। এদিকে আমরা যদি আমার এখনকার শহরের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাই এখানে তেমন কোন নদী নেই, বৃষ্টি হয়না অনেকদিন ধরে। ঢাকার তুলনায় এখানে পানির উৎস কম, পানির জন্য নিশ্চয় অনেক চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প নিতে হয়। এখানে পানিপ্রবাহ ব্যবহার করে মালামাল ও মানুষ পরিবহনের কোন সুযোগই নেই। থাকলে হয়তো সেটা কাজে লাগাতে পারতো। সেটা বোঝা যায় কৃত্রিমভাবে তৈরি করা একটা খালকে কত সুন্দরভাবে তারা বা সিটি কর্তৃপক্ষ সাজিয়ে রেখেছে। ওদিকে আবার যদি ঢাকার কথা বলি তবে দেখি দিনে দিনে ঢাকার আকার বাড়ছে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই। জলাভূমি ভরাট হয়েছে, খাল দখল ও ভরাট হয়েছে, কোথাও বক্স কালভার্ট বানানো হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি নামার কোনো পথ নেই।
এমনি আরো অনেকগুলো বিষয় তুলে আনা যায় যেখানে স্পষ্ট দেখা যায় এই দেশের এই বড় শহরটি এশিয়ার বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার তুলনায় অনেক বেশী পরিকল্পিত। কাগজে কলমে পরিকল্পনা আছে কিনা, মাস্টারপ্ল্যান আছে কিনা, ল্যান্ড ইউজ প্ল্যান আছে কিনা তার চেয়ে বড় কথা হলো পরিকল্পনা দৃশ্যমান কিনা। এই শহরের সুষ্টু পরিকল্পনা চোখের সামনে দৃশ্যমান যা ঢাকার সঙ্গে তুলনা করলে খালি চোখেই কয়েক গুন শ্রেয় মনে হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ সংগত কারনে আমি আমার বর্তমান দেশ ও শহরের নাম সচেতনভাবে উল্লেখ করিনি। বাংলাদেশে আমার জীবন ছিল চরম অনিরপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে যে কোন সময় আমি ইসলামী মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত ও জীবন হারানোর শংকায় থাকতাম। সেখানে আমার সেক্যুলার ও হিউম্যানিজম এক্টিভিজম ও লেখালেখির কারনে আমি মুসলিম মৌলবাদী জঙ্গিদের থেকে একাধিকবার হত্যার হুমকি পেয়েছি। আমার বাড়ির সামনে মব ক্রিয়েট করে আমাকে তারা হত্যার চেষ্টা করেছে একবার, আমাকে শারীরিকভাবে আক্রমন করেছে, যার ক্ষত আমি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। আজও তারা আমাকে জবাই করে হত্যা করার হুমকি দেয়,আমার অবস্থান জানতে চায়। সেজন্য আমি আমার বর্তমান অবস্থান পাবলিক করি না।
Related Posts
 
 
								In the Shadow of Famine: Bengali Food Habits – History, Practice, and Bodily Burden
About 10-12 days ago.I went to a large wholesale store, where products are usually soldRead More
 
 
								দূর্ভিক্ষের ছায়ায় বাঙালির খাদ্যাভ্যাসঃ ইতিহাস, অভ্যাস ও শরীরের দায়
প্রায় ১০-১২ দিন আগের ঘটনা। একটি বড় বিপণিবিতানে গিয়েছিলাম, যেখানে সাধারণত বক্স ধরে পণ্য কিনতেRead More
 
 
								Are religion, country, race, patriotism, and nationalism all racist concepts?
The only uncontacted human tribe left in the world today are the Sentinelese of NorthRead More

Comments are Closed