
Human Evolution
জিনে ধরার গল্প। মানুষের কিভাবে জিনে ধরে ?
১.
এক অর্ধপাগল মহিলা ছিল। তার ঘাড়ে ছিল ৩ টা ডাকসাইটে জিন। তো এই জিন প্রতিদিন রাতে পাড়ার মানুষের বাড়ি থেকে থালা, বাসন, ঘটি, বাটি, চাল, নুন এসব ঐ মহিলার বাড়িতে এনে দিতো। মহিলা ছিলো নির্দোষ, সব ঐ জিনের কাজ ছিল। মহিলা ২/১ বার ধরা পড়লেও সেটা ছিল জিনের ছদ্মবেশ। মহিলা নিষ্পাপ। তবে এই জিন আবার ছিল শুধুই পাড়াকেন্দ্রিক। ব্যাংকের সিন্দুক ভেঙে কোটি টাকা বা বস্তাভর্তি সোনা এনে দিত না। ছোটবেলা এমন জিন লাগতে দেখেছি কত মানুষের। ওঝা, ফকির এসে ঝাড় ফুক দিতো কত প্রকারে। এই যুগে এসেও কিন্তু ইউটিউবে অনেক ভিডিও আছে জিনের চলাফেরা দেখিয়ে, কত মানুষ সেলফি তুলেছে জিনের সঙ্গে! মানুষের শরীরে জিনের কিন্তু বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। এই জিন নিয়ে কত গবেষনা হয় উন্নত বিশ্বে! বিশ্বাস হয় না ? তাহলে নীচে পড়তে থাকুন।
২.
বিজ্ঞানীরাও কিন্তু জিন নিয়ে গবেষনা করে। জৈব বিজ্ঞানে জিন এখন এক বিষ্ময়কর নাম। প্রাণীদেহের কোষ এ থাকে ডিএনএ নামক একটা জৈব-রাসায়নিক অণু। প্রাণীর জীবন-ধারণের জন্য, বংশধারা রক্ষা এবং প্রজনন সক্ষমতার জন্য এ অণুটির ভূমিকা অপরিসীম। একটা প্রাণীর সকল শারীরিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত তথ্য এই ডিএনএ নামক অণুতে সংরক্ষিত থাকে। যেমন ধরুণ কেউ লম্বা হবে না বেঁটে হবে সেটা এই ডিএনএ এর একটা অংশের উপর নির্ভর করে। ডিএনএ এর এই অংশকে বলে জিন। জিন হচ্ছে কোষে অবস্থিত ডিএনএ এর অংশবিশেষ যেটিতে দেহের জন্য দরকারী প্রোটিন তৈরি করার কোড (তথ্য) থাকে। এই কোড আসলে কিছু রাসায়নিক অণুর (ফসফেট, সুগার, এবং বেইস) ক্রমাণুমিক অবস্থান ছাড়া আর কিছুই নয়। এই রাসায়নিক অণুগুলো কিভাবে সন্নিবেশিত আছে তার উপর নির্ভর করে কোষে প্রোটিন তৈরি হয়। সবচেয়ে দরকারী প্রোটিনটির নাম হচ্ছে এনজাইম। কোষে যতো ধরণের রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া হয় তার সবকিছু সম্ভব হয় এনজাইম এর উপস্থিতির কারণে। শরীরে কী ধরণের প্রোটিন তৈরি হচ্ছে সেটির উপর ভিত্তি করে প্রাণীর শারীরিক বৈশিষ্ট নির্ধারিত হয়। কোনো ডিএনএতে যদি শরীরকে লম্বা করার জন্য দরকারী জিন না থাকে তাহলে লম্বা হওয়ার জন্য যে প্রোটিন দরকার সেই প্রোটিনটি তৈরি হবেনা এবং ফলস্রুতিতে সেই শরীরটি লম্বা হবেনা।
মানুষ কি বানর থেকে এসেছে ? বিবর্তনবিরোধীরা এটা বলে থাকে । তবে বিবর্তন সম্পর্কিত কোন জ্ঞানের কোথাও এটা নেই। বলা হয় মানুষ, বানর, শিম্পাঞ্জী এই প্রাণীগুলো কোন কমন এনসিস্টর থেকে এসেছে। মানে এদের সবার কোন এক আদী পূর্বপুরুষ ছিলো।
প্রাণীর বিবর্তনের পিছনে এত বেশী প্রমান আছে যে এতটা প্রয়োজন ছিলো না। বিভিন্ন প্রাণীর ফসিল অবিষ্কার, এমনকি শত কোটি বছর আগের ফসিলও পাওয়া গেছে। মানুষের লক্ষ বছর আগের ফসিলও আছে। অথচ অনেকে দাবী করে বসেন পৃথিবীতে মানুষের আগমন সাত হাজার বছরেরও কম। বিবর্তন হাইপোথিসিস, থিওরি সব স্টেজ পার করে এখন একটা ফ্যাক্ট ! এই ২০১৮ সালে এসেও কেউ যদি বিবর্তনের বিপক্ষে কথা বলে তবে বুঝতে হবে তিনি বিজ্ঞান তেমন জানেন না। ফেসবুক, আলতু ফালতু সাইটে অনেক লেখা পাওয়া যায় বিবর্তনের বিপক্ষে কিন্তু সেগুলো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নয়। একমাত্র গ্রহনযোগ্য বৈজ্ঞানিক রেফারেন্স হলো স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক জার্নালগুলো। কেউ সেখান থেকে কোন রেফারেন্স দিতে পারবে ?
দক্ষিন ভারতে সাপের বিষের প্রতিষেধক অ্যান্টি ভেনাম তৈরি হয়। কিন্তু সেই এন্টিভেনাম একই প্রজাতির সাপের বেলা দক্ষিন ভারতে যে মাত্রা লাগে, পশ্চিমবঙ্গে তার অনেক বেশী লাগে। তার মানে একই সাপ, ধরুন কিং কোবরা। এই কিং কোবরার ক্ষেত্রে দক্ষিন ভারতের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিষের ক্ষমতা বেশী বা পরিমান বেশী। কয়েক শতাব্দী আগে যদি দেখেন তবে হয়ত দেখবেন এই ক্ষমতা ও পরিমান একই ছিলো ২ জায়গাতেই। আরো কয়েক হাজার বছর পরে গেলে দেখা যাবে এখনকার একই সাপ তখন ২ টা ভিন্ন প্রজাতি হয়ে গেছে। গায়ের রঙ, সাইজ, বিষের ধরন সব ভিন্ন।
বিবর্তন ঘটে লক্ষ, কোটি বছর ধরে। মানুষ চোখের সামনে হয়ত দেখতে পায় না তবে অনেক প্রমান আছে। যেমন এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার। এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছা ব্যবহারে ভাইরাস, ব্যকটেরিয়ার পরবর্তী প্রজন্ম ঐ এন্টিবায়োটিক সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করছে। তাই এখন নতুন নতুন এ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করতে হচ্ছে ও ডোজ বাড়িয়ে দিতে হচ্ছে। মশার কয়েল, এ্যারোসলে এখন মশা যায় না কারন মশার পরবর্তী প্রজন্ম সহ্য ক্ষমতা অর্জন করে নিচ্ছে।
বিবর্তন কাজ করে দুইটি প্রধান উপায়ে। এর একটি হচ্ছে ডিএনএ পরিবর্তন(mutation), এবং আরেকটি হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচন (natural selection).
ডিএনএ পরিবর্তনঃ
জীবকোষে অবস্থিত ডিএনএ মাঝে মাঝে পরিবর্তিত হয়। ডিএনএ যেহেতু আমাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে, তাই এর পরিবর্তন হওয়া মানে আমাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হওয়া।
প্রধানত দুটি কারণে ডিএনএ এর মধ্যে পরিবর্তন ঘটতে পারেঃ
১। কোষ বিভাজনের সময় সময় ডিএনএ এর প্রতিলিপি তৈরি করার সময়, এবং
২। তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ, অতিবেগুনি রশ্মি ইত্যাদি কারণে বাইরের পরিবেশের রাসায়নিক পদার্থ শরীরে প্রবেশ করে ডিএনএতে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে।
এই পরিবর্তনগুলোর উপর যেহেতু আমাদের হাত নেই তাই ডিএনএ এর যেকোনো অংশে (জিনে) এই পরিবর্তন হতে পারে। আর জিন যেহেতু আমাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে দেয়, তাই জিনের এই পরিবর্তন আমাদের শরীরকে প্রভাবিত করে। ডিএনএ এর এমন পরিবর্তন আমাদের জন্য উপকারী হতে পারে আবার অপকারীও হতে পারে। উদ্ভিদ এবং প্রানীর শরীরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যে পরিবর্তন আমরা দেখতে পাই সেটার কারণ হচ্ছে এই ডিএনএ অর্থাৎ জিন এর পরিবর্তন।
প্রাকৃতিক নির্বাচনঃ
ডিএনএ পরিবর্তন একটি র্যান্ডম প্রক্রিয়া। আগে থেকে জানার উপায় নেই যে কোনো পরিবর্তন ভালো, খারাপ, নাকি নিরপেক্ষ হবে। পরিবর্তনটি যদি খারাপ হয় তাহলে সেই প্রানী/উদ্ভিদ এর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। উদাহরণস্বরুপ, কোনো বন্য পোকার গায়ের রঙ নির্ধারণকারী জিন যদি এমনভাবে পরিবর্তন হয়ে যায় যে এর গায়ের রঙ বনের লতাপাতা বা গাছপালার রঙ এর চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে যায় যেটা সহজেই এর খাদক শিকারী প্রাণীর চোখে পড়ে, তাহলে শিকারীর পাল্লায় পড়ে সে পোকাটি আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে চলে যাবে। অন্যদিকে জিনটি যদি এমনভাবে পরিবর্তন হতো যে পোকাটির গায়ের রঙ বনের অন্যান্য গাছপালা লতাপাতার রঙের সাথে মিশে যেতো যাতে পোকাটিকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়তো, তাহলে পোকাটির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যেতো। আর এভাবেই নতুন জিনটি বংশ-পরম্পরায় প্রাবাহিত হয়ে যাবে। ডিএনএ এর মাঝে জিন এর র্যান্ডম পরিবর্তন থেকে বেঁচে থাকার জন্য, পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করার জন্য উপকারী জিনটিকে নির্বাচন করার প্রক্রিয়াটিকে বলে প্রাকৃতিক নির্বাচন।
লক্ষ্য করে দেখবেন, ডিএনএ পরিবর্তন এর ব্যাপারটি র্যান্ডম হলেও অনেকগুলি র্যান্ডম পরিবর্তন থেকে দরকারী বা উপকারী জিনটিই খুব যত্ন করে নির্বাচন করে প্রাকৃতিক নির্বাচন। এর মানে হচ্ছে, কোন জিনটি জীব দেহে বংশানুক্রমিকভাবে প্রবাহিত হবে সেটি খুব জেনে, শুনে, বেছে ঠিক করা হয়। আর এভাবেই জীবের বিবর্তন ঘটে আরো অধিকতর শক্তির শরীর তৈরির দিকে, দুর্বল বা অপ্রয়োজনীয় অংগগুলি আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হয় কিংবা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
১ নাম্বার অংশে মানুষের ঘাড়ে লাগা জিন আর ২ নাম্বার এ বর্নিত জিন কিন্তু এক না
Related Posts

Sunlight: A Natural Medicine, Cultural Wisdom, and the Key to Healthy Longevity
For thousands of years, many civilizations have worshipped the sun as a deity – notRead More

সূর্যের আলো: প্রাকৃতিক ঔষধ, সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকর দীর্ঘায়ুর চাবিকাঠি
হাজার হাজার বছর ধরে অনেক সভ্যতা সূর্যকে দেবতা মানে; শুধু বৈদিক, পৌরাণিক, এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য,Read More

Protecting women is a man’s responsibility – this is a lesson rooted in evolutionary psychology
A common tendency across all societies is to take extra care of women. This isRead More
Comments are Closed