Food
Famine and Food Habit

Famine and Food Habit

দূর্ভিক্ষের ছায়ায় বাঙালির খাদ্যাভ্যাসঃ ইতিহাস, অভ্যাস ও শরীরের দায়

প্রায় ১০-১২ দিন আগের ঘটনা।
একটি বড় বিপণিবিতানে গিয়েছিলাম, যেখানে সাধারণত বক্স ধরে পণ্য কিনতে হয় এবং পাইকারি মূল্যে পাওয়া যায়। সেখানে প্রবেশ ও কেনাকাটার জন্য আলাদা ফি দিয়ে বার্ষিক সদস্যপদ নিতে হয়। বিপণিবিতানের বিভিন্ন টেবিলে খাবারের স্যাম্পল সাজানো থাকে, যা মার্কেটিং বিভাগের নারী কর্মীরা প্রস্তুত করে সম্ভাব্য ক্রেতাদের পরিবেশন করেন। আমি একটি টেবিলের সামনে গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। তখনো সেই নারী কর্মী খাবার তৈরি করে সাজাচ্ছিলেন। আমার পেছনে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন অপেক্ষমাণ ছিলেন। এমন সময় এক নারী এলেন – দেখে মনে হলো হিস্পানিক। তিনি সরাসরি লাইনের সামনে গিয়ে লম্বা করে হাত বাড়িয়ে সবার আগে একবাটি স্যাম্পল খাবার নিতে চাইলেন। নারী কর্মী বিনয়ের সঙ্গে জানালেন, সামনে অনেকেই অপেক্ষা করছেন, তাই তাকে ধৈর্য ধরতে হবে। ঠিক তখনই আমাদের আরেকজন বাঙালি সেখানে এসে দাঁড়ালে আমি তাকে বললাম, “এই মহিলা তো লাইনের নিয়ম ভেঙে আগে খাবার নিতে অস্থির হয়ে গেছে!”

এই বিদেশ বিভূঁইয়ে ভাষার স্বাধীনতা এটা – যেহেতু আশেপাশের কেউ বাংলা বোঝে না, তাই লুকিয়ে কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু আমাদের বিস্মিত করে দিয়ে সেই মহিলা কটমট করে তাকিয়ে বললেন, “আমি বাংলা বুঝি!” আমি মুহূর্তেই লজ্জায় পড়ে গেলাম। তার সামনেই তাকে সমালোচনা করেছি, অথচ তিনি যে বাঙালি – তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। তবে যেটা আরও অবাক করল, তা হলো – তিনি নিয়ম ভেঙে শিষ্ঠাচার লঙ্ঘন করেও নিজের পক্ষে গলা উঁচু করলেন! এমন পরিস্থিতিতে চুপ থাকা হয়তো তার জন্যই শোভন হতো। তার কথার টোনে মনে হলো, তিনি কলকাতা অঞ্চলের কেউ।

একবার বাংলাদেশের এক অতিরিক্ত সচিব শোনাচ্ছিলেন শেরাটন হোটেলের একটি ঘটনা। সেদিন সেখানে দেশের নামকরা ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ আমলা ও রাজনীতিবিদদের নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভা শেষে আয়োজন ছিল বাফেট লাঞ্চের। সভাপতির সমাপনী বক্তব্য তখনো শেষ হয়নি – প্রায় ১০ মিনিট বাকি। অথচ এরই মধ্যে অধিকাংশ অতিথি হুড়মুড় করে খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েন, যেনো আগে না গেলে কেউ খাবার পাবে না! অতিরিক্ত সচিবসহ কয়েকজন ধৈর্য ধরে বক্তব্য শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু যখন তারা লাইনে গেলেন, তখন অনেক খাবারই শেষ হয়ে গেছে। আরেকটি দৃশ্য তাদের চোখে পড়ে – অনেকেই প্লেটভর্তি খাবার নিয়ে বসেছেন, কিন্তু বেশিরভাগই খাওয়া হয়নি। খাবার নষ্ট হচ্ছে, অথচ যারা নিয়ম মেনে অপেক্ষা করেছেন, তারা অনেক কিছুই পাননি।

খাবার নিয়ে আমাদের জাতিগত মনোভাব এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বে ভরা। বিশ্বের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এমন “খাই খাই” স্বভাব কতটা আছে, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে একটা বিষয় চোখে পড়ে – অনেকে প্রচুর খাবার নষ্ট করে, সদ্য এক্সপায়ার্ড হয়ে যাওয়া জিনিস অনায়াসে ট্র্যাশে ফেলে দেয়। অন্যদিকে, আমরা বাঙালিরা – যারা অভাবের মধ্যে বড় হয়েছি, খাদ্যকষ্টের বাস্তবতা দেখেছি – তাদের কাছে খাবারের প্রতিটি দানাই অমূল্য। আমরা চাই না একটুও নষ্ট হোক। এই মানসিকতা থেকে অনেক সময় এমনও হয়, খাবার অপচয় না করতে গিয়ে বিষ সমতুল্য অতিরিক্ত কার্ব খেয়ে শরীরের বারোটা বাজিয়ে ফেলি। এক্সপায়ার্ড খাবারও আমরা শেষ পর্যন্ত ফেলার আগে বহুবার ভাবি – যদিও এক্সপায়ার্ড মানেই খাবার অযোগ্য, এমনটা সবসময় নয়। এই প্রবণতা থেকে জন্ম নেয় এক ধরনের “খাওয়ার দায়” – যা কখনো অভ্যাস, কখনো সংস্কার, কখনো প্রয়োজন। ফলাফল? অনেকের পেট ঢোলের মতো হয়ে যায়। শারীরিক গঠন হয়ে পড়ে অনিয়ন্ত্রিত, বেঢপ। ফিটনেস – এই শব্দটা আমাদের চর্চায় নেই বললেই চলে। আমাদের খাদ্যাভ্যাসে যেমন আবেগ, তেমনি আছে অপরিহার্যতা। কিন্তু স্বাস্থ্যবোধ, শরীরচর্চা, সচেতনতা – এসব যেন এখনও আমাদের সংস্কৃতির প্রান্তে পড়ে থাকে।

খাবার শুধু পেট ভরানোর উপকরণ নয় – এটি সংস্কৃতি, ইতিহাস, এবং বেঁচে থাকার সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে যে অতিরিক্ত কার্ব গ্রহণ, বিশেষ করে ভাতের প্রতি অদম্য আকর্ষণ, তা শুধু স্বাদের কারণে নয় – এর পেছনে রয়েছে এক করুণ ঐতিহাসিক বাস্তবতা যা জেনেটিক্যলি বাঙালিকে একেবারে বদলে দিয়েছে। একদা সুখী সমৃদ্ধ বাঙালিরা হয়ে পড়েছিল অভাবী, দরিদ্র। যুগের পর যুগ বিদেশী দখলদারদের লুন্ঠন, কৃষি উৎপাদনের উপর তাদের লোভ ও শোষণ, এবং তার ফলে ঘটা ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ – এসব মিলিয়ে গড়ে উঠেছে এক ধরনের “খাওয়ার দায়”, যা আমাদের জেনেটিক ও সামাজিক আচরণে গভীর ছাপ ফেলেছে।

ঔপনিবেশিক শোষণ ও কৃষি লুণ্ঠনের ইতিহাস আমাদের বদলে দিয়েছিল খুব খারাপভাবে, যার প্রভাব আমরা আজও দেখি দেশের সর্বত্র, লুটপাট, দুর্নীতির মহোৎসব সবই সেই ঐতিহাসিক বাস্তবতার উত্তরাধিকার। বাংলা অঞ্চল – বিশেষ করে বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ – ঐতিহাসিকভাবে ছিল কৃষি উৎপাদনে সমৃদ্ধ। এই অঞ্চলের ধান, পাট, চিনি, নীল, এবং অন্যান্য কৃষিপণ্য বিদেশী শক্তির নজর কেড়েছিল। মুঘল শাসনের শেষ দিকে এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শুরুতে এই কৃষি উৎপাদনকে কেন্দ্র করে শুরু হয় ভয়াবহ লুণ্ঠন। ব্রিটিশরা স্থানীয় কৃষকদের বাধ্য করে নীল ও অন্যান্য নগদ ফসল চাষে, যার ফলে খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমে যায়। ফলাফল? প্রতি শতাব্দীতে একাধিক দূর্ভিক্ষ, যার মধ্যে ১৭৭০ সালের গ্রেট বেঙ্গল ফ্যামিন এবং ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর সবচেয়ে ভয়াবহ।

দূর্ভিক্ষ ও খাদ্যসংকট ছিল এক জাতিগত স্মৃতি যা টিকে থাকার স্বার্থে মিউটেশনে ও পরে জেনেটিক্সে গেঁথে গেছে। এই দূর্ভিক্ষগুলো শুধু অর্থনৈতিক বিপর্যয় নয়, বরং মানুষের মনোজগতে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। দিনের পর দিন না খেয়ে থাকার অভিজ্ঞতা, খাবারের জন্য হাহাকার, এবং মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া – এসব অভিজ্ঞতা প্রজন্মের পর প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক ধরনের “খাদ্য-সংগ্রহ প্রবৃত্তি” – যেখানে সামনে খাবার পেলে যতটা সম্ভব খেয়ে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সবার আগে, যতোটা সম্ভব খেয়ে নেয়ার ভয়ংকর প্রতিযোগীতা সেই প্রবনতার ফল। এটি শুধু মানসিক নয়, বরং জেনেটিক অভিযোজনের অংশ হয়ে উঠেছে।

বাঙালির প্রধান খাদ্য উপাদান ভাত। ভাত এমন একটি খাদ্য, যা লবণ, কাঁচামরিচ, তেল বা সামান্য তরকারি দিয়েও খাওয়া যায়। দূর্ভিক্ষের সময়েও ভাত ছিল সবচেয়ে সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী খাদ্য। এই কারণে ভাতের প্রতি আমাদের এক ধরনের আবেগ ও নির্ভরতা তৈরি হয়েছে। আজও অনেক পরিবারে তিনবেলা ভাত খাওয়ার রীতি প্রচলিত, যদিও পুষ্টিবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অতিরিক্ত কার্ব গ্রহণ শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

এই অতিরিক্ত ভাত খাওয়ার অভ্যাস, খাদ্য অপচয় না করার মানসিকতা, এবং “খাওয়ার দায়” – সব মিলিয়ে আমাদের শরীরের গঠনে প্রভাব ফেলেছে। অনেকের পেট হয়ে যায় ঢোলের মতো, শরীরের গঠন হয়ে পড়ে অনিয়ন্ত্রিত। ফিটনেস, শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যসচেতনতা – এসব শব্দ আমাদের দৈনন্দিন চর্চায় নেই বললেই চলে। আমরা খাবারকে শুধু প্রয়োজন নয়, আবেগ ও সংস্কারের অংশ হিসেবে দেখি। ফলে স্বাস্থ্যবোধের জায়গায় আসে “না ফেলার দায়”, “অপচয় না করার সংকল্প”, এবং “যতটা সম্ভব খেয়ে নেওয়ার অভ্যাস”।

বাঙালির খাদ্যাভ্যাসকে বিশ্লেষণ করতে গেলে শুধু সামাজিক নয়, জেনেটিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ভাবতে হয়। দূর্ভিক্ষে টিকে থাকা মানুষের শরীর এমনভাবে অভিযোজিত হয়েছে যে তারা কম ক্যালোরিতে বেঁচে থাকতে পারে, এবং খাবার পেলে দ্রুত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে চায়। এই জেনেটিক স্মৃতি প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়ে, এবং আজও আমাদের আচরণে তার ছায়া দেখা যায়। সেজন্য বাঙালির খাদ্যাভ্যাসকে শুধুই “খাই খাই” বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এর পেছনে আছে শতাব্দীর শোষণ, দূর্ভিক্ষ, এবং বেঁচে থাকার সংগ্রাম – যে ঘটনাগুলোর জন্য মূলত বাঙালিরা দায়ী ছিল না, বাঙালিদের শোষন করা হয়েছিল, তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে অন্যরা ধনী হয়েছিল। তবে সেই ইতিহাসকে বুঝে আমাদের এখন প্রয়োজন স্বাস্থ্যবোধ, সচেতনতা, এবং শরীরচর্চার সংস্কৃতি গড়ে তোলা। খাবার শুধু বেঁচে থাকার উপকরণ নয় – এটি শিষ্টাচার, সংবেদনশীলতা, এবং ভবিষ্যতের প্রতিফলন। এটা আমাদের সংস্কৃতিতে এখন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

Related Posts

Famine and Food Habit

In the Shadow of Famine: Bengali Food Habits – History, Practice, and Bodily Burden

About 10-12 days ago.I went to a large wholesale store, where products are usually soldRead More

North Sentinelese

Are religion, country, race, patriotism, and nationalism all racist concepts?

The only uncontacted human tribe left in the world today are the Sentinelese of NorthRead More

North Sentinelese

ধর্ম, দেশ, জাতি, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ সবই কি বর্ণবাদী কনসেপ্ট?

পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত একমাত্র আন কন্টাক্টেড মনুষ্য প্রজাতি আমাদের বঙ্গোপসাগরের নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপের সেন্টিনেলীরা। তারাRead More

Comments are Closed