Dhaka
An Inhumane City

An Inhumane City!

ঢাকা নামের এক অমানবিক শহরের কথা

আমি সচারচর সরকারী অফিস, পুলিশ ও ঢাকার রাস্তা এড়িয়ে চলতে চাই। আমি নিরীহ গো-বেচারা টাইপ একজন অতি সাধারন নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ। মাঝে মধ্যে যখন রাস্তায় থাকি তখন দেখি এ শহরের মানুষের কি নিদারুণ কষ্ট। সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত কি যে দূরাবস্থা মানুষের! একটু বৃষ্টি হলে সেই কষ্ট, দুর্ভোগ বেড়ে হয়ে যায় দশগুন, কর্ম থেকে ফেরা ক্লান্ত নারীদের দেখলে মনে হয় তারা নরকে পড়ে গেছেন! যারা নিজের এসি গাড়িতে চড়ে অভ্যস্ত তারা জানবে না মানুষের এই কষ্ট। সকাল ৬ টায় উঠে বাজার করে, তৈরি হয়ে ২ ঘন্টা হাতে সময় নিয়ে কর্মস্থলের দিকে বের হয় মানুষ। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১১ টা। শুধু একটু ঘুম ও সংসারের টানে মানুষ মাত্র কয়েকঘন্টা নিজের জন্য পায়।

আজ সন্ধ্যায় আমরা মোট ৪ জন বের হয়েছিলাম ধানমন্ডির ল্যাব এইডের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে ছিলো একজন খুবই ক্রিটিক্যাল রোগী। মিরপুর রোডের পূর্বপাশ পুরোটা স্থবির। জমে গেছে সবকিছু, মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে এই হাজার হাজার গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে একের পরে এক। ১৫ মিনিটের পথ দেড় ঘন্টা লাগিয়ে ওভারব্রীজের পশ্চিমপাশে নামলাম। এ শহরে হার্টের রোগী, প্রেগন্যান্ট মহিলা, পঙ্গু, হুইলচেয়ার যাত্রী কারো জন্য ভেবে কিছু করা হয় না, না রাস্তা, না কোন বিল্ডিং, সবই টাকা লুটপাট ও কামানোর ব্যবস্থা, সাধারন মানুষের পকেট কাটা পড়লেই সবাই খুশি। সবাই ওভারব্রীজ দিয়ে কারো সাহায্য নিয়ে বা ছাড়া পার হতে পারবে কিনা সেটা কেউ ভাবেনা। আশেপাশে কোন জেব্রা ক্রসিং থাকে না এখানে। জেব্রা ক্রসিং থাকলেও রঙ নেই। রঙ থাকলেও কোন গাড়ি সেখানে থামে না। কি অসভ্য, অমানবিক এক শহর এই ঢাকা! দুনিয়ার আর কোথায় পথচারী মানুষের জন্য এমন দুর্ভোগের ওভারব্রীজ থাকে? কোন দেশে? কোন শহরে?

ফেরার পথে দেখি সহস্র মানুষের প্রতিযোগীতা। কে কাকে রেখে আগে বাস, সিএনজি অটোরিক্সা, রিক্সা ধরবে। ধানমন্ডির চক্রাকার এসি বাসে তিল ধারনের স্থান নেই। আমাদের সঙ্গে ক্রিটিকাল পেশেন্ট, তাও আবার মহিলা। কোন উপায় নেই ফেরার। বাস, অটোরিক্সা, রিক্সা, উবার, পাঠাও সব চেষ্টা করে বিফল হলাম আমরা। এত এত মানুষ। কর্মক্লান্ত মানুষগুলোর প্রতিদিন এই জীবনযুদ্ধে সামিল হতে হয়। কোন কোন আহাম্মক আবার এই ঘর্মাক্ত মানুষগুলোর মুখের উপর সমানে সিগারেটের ধোঁয়া ফুকছে। এক জায়গায় অসুস্থ মানুষটিকে বসিয়ে রাখলাম।

বিপরীত দিক থেকে আসা ৫৫-৬০ বছর বয়সী (আনুমানিক) এক ভদ্র লোক জিজ্ঞাসা করলো “বাবা আমি যাত্রাবাড়ী যাব, আমি কি ঠিক রাস্তায় আছি?” তার কথা শুনে মাথাটা চক্কর দিতে থাকলো আমার। ধানমন্ডি থেকে যাত্রাবাড়ী যাবে হেটে…আমি বললাম “চাচা, যাত্রাবাড়ী তো অনেক দূর, আপনি বাসে উঠেন অথবা রিক্সা,সিএনজি নেন।” চাচার মলিন মুখে জবাব “মোহাম্মদপুর থেকে হেটে আসতেছি..শেষ গন্তব্য ডেমরা করিম জুট মিলে।” এবার যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল আমার মাথায়। এই বয়সী একটা মানুষ মোহাম্মদপুর থেকে হেটে ডেমরা যাচ্ছে । সাহস করে জিজ্ঞাসা করলাম “আপনি হেটে যাচ্ছেন কেন? বাসে যেতেন” চাচা কাচুমাচু করতেছে…বুঝতে পারলাম উনি উত্তর দিতে লজ্জা পাচ্ছেন।

নিজেই বললাম “আপনার কি টাকার সমস্যা? আমাকে বলতে পারেন” এবার চাচার বাধ ভেঙ্গে গেল… দুচোখ বেয়ে কয়ে ফোটা অশ্রু গড়াতে লাগলো, সরুকন্ঠে শুধু বলল “চাকুরী করতাম, পেনশনের কিছু টাকা পাই সেই টাকা তুলতে গিয়ে আমার জীবনটাই শেষ হওয়ার পথে, মোহাম্মদপুর গিয়েছিলাম এলাকার এক অফিসারের কাছে, যাতে সে একটু বলে দেয়, আশা দিয়েছে দেখি কি হয়।” চাচার চোখের পানি দেখে কখন যে নিজের চোখের পানি বেরিয়ে এসেছে বুঝতেই পারিনি। মানিব্যাগে দেখি আমার কাছে ১১০ টাকা আছে । নিজের জন্য ৫০ টাকা রেখে তাকে ৬০ টাকা দিলাম আর বললাম “সাইন্স ল্যাব মোড় থেকে সায়েদাবাদ,যাত্রবাড়ীর বাস আছে …বাসে চলে যায়েন।” এত বছর সার্ভিস করার পর পেনশনের টাকা তুলতে মানুষকে যদি চোখের পানি ফেলতে হয়, মোহাম্মদপুর থেকে ডেমরা হেটে চলতে হয়! তাও এই বয়সে!

এখন আমার নিজেরই তো টাকার দরকার, সামনে এক এটিএমের দিকে গেলাম টাকা তুলতে। এরপর ফিরে এলাম যেখানে রোগীকে বসিয়ে রেখেছিলাম। রাস্তার যে অবস্থা তাতে আরো কতোক্ষন পরে কেউ একজন রাজী হবে নিয়ে যেতে জানিনা। রাজী হলেও যে টাকা চাইবে তা হয়তো নায্য ভাড়ার কয়েকগুণ বেশী – আমার কষ্টের উপার্জন, এই বাড়তি অনায্য টাকা খরচ করাটা গায়ে কাঁটার মতো বিঁধে।

দেড় ঘন্টা চেষ্টার পরে ভেঙ্গে ভেঙ্গে আমরা ফিরেছি। ঢাকা শহরের রাস্তায় বের হয়ে এমন ভোগান্তিতে না পড়লে বুঝবেন আপনি স্বপ্ন দেখছেন। এই ঘটনাগুলোই কিন্তু অনেকের নিত্যদিনের ঘটনা।

এ শহর আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্ত, গরীব, নারী, শিশুদের জন্য খুবই অমানবিক। শারীরিক, মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য তো রীতিমত অভিশাপ। আমাদের যাদের নিজেদের গাড়ি বা ড্রাইভার রাখার সংস্থান হয়না তাদের জন্য এখানে চলা খুবই কষ্টকর। একটু হিসাবের গরমিল হলেই বা অন্য কারো ভুলে রাস্তায় চলে যাবে জীবন। কিন্তু জীবন সংগ্রাম তো থেমে থাকে না।

এই শহরের মানুষেরা একটা সম্পদের লোভে নিজের রক্ত সম্পর্কের বাবা-মা, ভাই-বোনকে ত্যাগ করে সেকেন্ডে। মৃত্যুপথযাত্রী কারো সর্বস্ব লুট করে নিতে ভাববে না অনেকে। কেউ হয়ত নেশার টাকার জন্য আপনজনকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। দেশের মানুষের টাকা লুটপাট করে নিজের সম্পদের পাহাড় গড়ে অনেকে। কে কাকে রেখে, কার কাছ থেকে কী ছিনিয়ে নিয়ে উপরে উঠবে সেটাই এখন এখানকার মূল স্রোত।

তবে রক্তসম্পর্কের কেউ না হলেও কোন কোন মানুষ কখনো তার চেয়ে বড় কিছু হয়ে উঠে। আমাদের সঙ্গে আজ আমাদের এক ছোটভাই ছিলো। সে নিজে অসুস্থ থেকেও এই অমানবিক শহরে আশার আলোর মশাল হাতে দাঁড়িয়েছে। এদের আলোতেই হয়ত একদিন ঘুচে যাবে সব অন্ধকার। মানবিকতার যাত্রা শুরু হবে একদিন।

Related Posts

DUCSU election 2025

Was this unexpected victory of Shibir in the DUCSU election actually expected?

At Dhaka University, Shibir is winning simply by securing votes – that’s the reality. AcrossRead More

DUCSU Election 2025 and Shibir

ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের এই অপ্রত্যাশিত বিজয় কি প্রত্যাশিতই ছিল?

ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে শিবির ভোট পেয়েই জিতছে, এটাই বাস্তবতা। বাংলাদেশের সবক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্ট কিছু না কিছু ভুলRead More

15 February 1996 Election

১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন – বি এন পি যেভাবে গনতন্ত্র ধ্বংস করেছিল

২০২৪ এর ঐতিহাসিক গণ-অভভুত্থানের আগে ১৯৯০ সালে ছাত্র জনতার ত্যাগের বিনিময়ে দেশে গণতন্ত্র বিকাশের যেRead More

Comments are Closed